প্রফেসর হুমেইরা ইক্তিদার তাঁর ‘Jizya against Nationalism: Abul A‘la Maududi’s Attempt at Decolonizing Political Theory’ প্রবন্ধে আবুল আ’লা মওদূদীকে (রহিমাহুল্লাহ) থিয়োলোজিয়ান হিসেবে না দেখে ডিকোলোনিয়াল পলিটিকাল থিংকার হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। মওদূদী (রহিমাহুল্লাহ) মূলত একজন রাষ্ট্রতাত্ত্বিক। অন্যদের সাথে তাঁর পার্থক্য এই জায়গায় যে, পশ্চিমা রাষ্ট্রচিন্তার সাথে ক্রিটিক্যালি এনগেজড হয়ে রাষ্ট্রতত্ত্ব নির্মাণে তিনি ইসলামিক রিসোর্স ব্যবহার করেছেন। ইসলামের নানা বিধিবিধানকে তিনি তার রাষ্ট্রকল্পনার ভেতর দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। মওদূদীর (রহিমাহুল্লাহ) তৈরি করা একটা বিশেষ শব্দ হলো মিজাজ-সিনাস-ই-রাসুল। এটি দ্বারা সেই ব্যক্তিকে বোঝানো হয় যিনি কুরআন-সুন্নাহ-ফিকহের এমন সমঝ অর্জন করেছেন যার বদৌলতে তিনি বুঝবেন যে, রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বেঁচে থাকলে এই পরিস্থিতিতে এই এই কাজ করতেন বা এই এই কথা বলতেন। এভাবে যেকোনো পরিস্থিতিতে ইসলামের ভাষ্য কী হবে- এটা মুজতাহিদ এই আলেম কিতাব ও সুন্নাহর আলোকে বুঝে যাবেন৷
যাইহোক, পশ্চিমা রাষ্ট্রতত্ত্বের একাধিপত্য মওদূদী মেনে নেননি এবং এক্ষেত্রে তার জন্য সহায়ক হয়েছে ইসলামের ভাবসম্পদ, ইসলামের ঐতিহাসিক, তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক নানা অনুষঙ্গ। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রচিন্তার ‘জেহনি গুলামী’ বা বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (ইন্টেলেকচুয়াল স্লেভারি)- এর বাইরে এসে রাষ্ট্র, সার্বভৌমত্ব, চিন্তা, স্বাধীনতা, মাইনোরিটি কোশ্চেন, নাগরিকতা ও আনুগত্যের প্রশ্ন ইত্যাদি নিয়ে বেশ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তিনি। লিবারেল ও সোশালিস্ট রাষ্ট্রচিন্তার বিপরীতে/প্রতিক্রিয়ায় তিনি ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তা হাজির করেছেন। সোশালিজম, লিবারেলিজমের মতোই ইসলাম তাঁর কাছে একটি মতাদর্শ, দর্শন ও জীবনব্যবস্থা; শুধু পার্থক্য হচ্ছে: এটা খোদাপ্রদত্ত ও খোদার সার্বভৌমত্বের (হাকিমিয়্যাহ) উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।
মওদূদীর চিন্তাকে পশ্চিমা লিবারেল রাষ্ট্রচিন্তার ক্রিটিক হিসেবেও পাঠ করা যাবে। তবে একটা মজার প্যারাডক্স হচ্ছে: তাঁর তত্ত্ব একই সাথে যেমন পশ্চিমা রাষ্ট্রতত্ত্বের বিরোধিতা করে, তেমনই তাকে কনফার্মও করে; কারণ, আধুনিক ‘রাষ্ট্র’-এর ধারণাটি মূলত পশ্চিমা-ই, আর ‘রাষ্ট্রের লেন্স’ দিয়ে দেখাও একটা পশ্চিমা পদ্ধতি। খেলাফত পতনের পর এবং উপনিবেশোত্তর কালে যে রাষ্ট্রসমূহ তৈরি হয়েছে, সেগুলো জাতিরাষ্ট্রিক কাঠামো ব্যবহার করেই বিকাশমান। এমনকি অনেক তাত্ত্বিক এমনও বলে থাকেন যে, খেলাফত ব্যবস্থাও তৎকালীন ‘সাম্রাজ্য’-এর কাঠামো ব্যবহার করে সেটার কিছুটা ‘ইসলামীকরণ’ করেছে। সুতরাং, (এসব তাত্ত্বিকদের মতে) জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোকে ব্যবহার করা অনৈসলামিক কোনো ব্যাপার না, যদিও এই কাঠামো মূলত ‘মডার্ন’ কাঠামোই।
মওদূদীর রাষ্ট্রচিন্তার একটা দিক বোঝা যায় মুরতাদের শাস্তি সংক্রান্ত তাঁর ভাবনায়। ইসলামে মুরতাদের ধারণা, অর্থাৎ ইসলাম ত্যাগের শাস্তি সংক্রান্ত ধারণাকে মওদূদী রাষ্ট্রের লেন্স দিয়ে দেখেছেন। যে রাষ্ট্রের ভিত্তি-আদর্শ ইসলাম, সেই রাষ্ট্রে কোনো নাগরিক যদি ইসলাম ত্যাগ করে তবে সেটি স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা। এটা যতটা না থিওলোজিক্যাল ব্যাপার, তারও চেয়ে বেশি রাষ্ট্রিক ব্যাপার হিসেবে মওদূদী একে উপস্থাপন করেছেন।
উপরোক্ত পদ্ধতিতে ইরতিদাদ বা ইসলাম-ত্যাগকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে ব্যাখ্যা করা একটা আধুনিকতাবাদী চিন্তা। তবে ইসলামিস্টরা (মুসলিম মাত্রই ইসলামপন্থী। এখানে ইসলামিস্ট বা ইসলামপন্থী নামে নতুন শব্দের প্রয়োজন নেই। ইসলামপন্থী না হলে কেউ মুসলিম থাকতে পারে না- সম্পাদক) এন্টি-মডার্ন না। কলোনিয়াল মডার্নিটির বিপরীতে তাদের আধুনিকতার বিকল্প প্রস্তাব আছে। তালাল আসাদ, শাদি হামদি, অলিভার রয়, ইরফান আহমেদ, হুমেইরা ইক্তিদারদের ভাবনা এমনই। চার্লস টেলর, এমনকি তহা আব্দুর রহমানেরাও মাল্টিপল মডার্নিটির ধারণা পোষণ করেন। আব্দুর রহমান তহা তো আধুনিকতার স্পিরিট ও আধুনিকতার এপ্লিকেশন, এই দুটো ব্যাপারকে আলাদা করেন। তিনি মনে করেন যে, আধুনিকতার চেতনার পশ্চিমা এপ্লিকেশন জগতের জন্যে ক্ষতিকর হয়েছে। তার মতে, আধুনিকতার স্পিরিটের ইসলামিক এপ্লিকেশন মানবতার জন্য অনেক বেশি কল্যাণকর ও টেকসই। আধুনিকতার স্পিরিট ও আধুনিকতার এপ্লিকেশন- এইভাবে পার্থক্য করাকে অবশ্য ওয়ায়েল হাল্লাক সমস্যাযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। (ইসলাম পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, আধুনিকতা বা অন্যান্য মতাদর্শের মুখাপেক্ষী নয়। কুরআন-সুন্নাহ সমস্ত মূলনীতির ভাণ্ডার, তবে মুজতাহিদ আলেমগণ যুগের প্রয়োজনে ইজতিহাদ করবেন এবং সেই ইজতিহাদও ইসলামের মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে- সম্পাদক)
হুমেইরা ইক্তিদার আল্লামা মওদূদীর জিজিয়া সংক্রান্ত আলোচনাকে ‘ডিকলোনাইজেশন প্রজেক্ট’- এর বৃহত্তর বর্গের অন্তর্ভুক্ত করে আলোচনা করেছেন। রাজনৈতিক চিন্তার ইউরোসেন্ট্রিজম ও কলোনিয়াল লিগ্যাসিকে চিহ্নিত করা, প্রশ্ন করা ও অইউরোপীয় রাষ্ট্রচিন্তাকে পরখ করে বুঝে নেওয়া ইক্তিদারের অন্যতম তাত্ত্বিক লক্ষ্য। তাই তিনি আবুল আ’লা মওদূদীর ‘জিজিয়া’র বিশ্লেষণ ও জাভেদ আহমেদ গামিদির টলারেন্স বা সহনশীলতার আলাপকে পশ্চিমা লিবারেলিজমের সাথে তুল্যমূল্য করে আলাপ পাড়েন তাঁর দুটো বিখ্যাত আর্টিকেলে। একটির নাম ‘Jizya against Nationalism: Abul A‘la Maududi’s Attempt at Decolonizing Political Theory’ এবং অপরটির নাম ‘Is Tolerance Liberal? Javed Ahmad Ghamidi and the Non-Muslim Minority.’
মাওলানা মওদূদী (রহিমাহুল্লাহ) পশ্চিমা পলিটিক্যাল ক্যাটেগরিগুলোর সাথে বিচারমূলকভাবে সম্পৃক্ত হয়ে একধরনের ‘থিয়োডেমোক্রেসি’র ধারণা প্রবর্তন করেছেন। তিনি পশ্চিমা রাষ্ট্রদর্শনে অহরহ আলোচিত বিষয়সমূহ, যেমন: সার্বভৌমত্ব, আইন, জাতীয়তাবাদ, সংবিধান, সেকুলারিজম ইত্যাদিকে ইসলামী চিন্তাকাঠামো দিয়ে বিচার করেছেন। আবার, ইউরোপীয় লিবারেলিজম বা লিবারেল ডেমোক্রেসির প্রপঞ্চসমূহের- যেমন: ইকুয়ালিটি, ইউনিভার্সাল রাইটস, মাইনোরিটি রাইটস- পাশাপাশি জারি থেকেছে ঔপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ ও নানা কিসিমের বৈষম্য। ইকুয়ালিটি ও সার্বজনীন মানবাধিকারের ধারণা পশ্চিমারা কখনোই তাদের উপনিবেশের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেনি। ইসলামী রাষ্ট্র ধর্মীয় মাইনোরিটির সাথে এমন কোনো কৃত্রিম সমতার ভান করে না। ইসলামি রাষ্ট্র ধর্মীয় মাইনোরিটিকে বিশেষভাবে ডিল করে। হুমেইরা ইক্তিদার আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্বের ভাষায় মওদূদীর ইন্টারভেনশনকে ব্যাখ্যা করেছেন। মুসলিমরা যাকাত দেয় আর অমুসলিমরা জিজিয়া দেয়। ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিম ও অমুসলিমদের আনুগত্যের ধরণ ভিন্ন, কিন্তু তাদের সবার জন্যেই মর্যাদা, অধিকার ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি থাকবে। ইসলামি রাষ্ট্রের জিহাদের ডাকে সাড়া দেওয়া মুসলিমদের জন্য আবশিক, কিন্তু ‘যিম্মি’দেরকে এ দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। জিজিয়া একটা নেগোশিয়েটেড প্যাক্ট। মুসলিম-অমুসলিম সবাইকে নিয়ে ইসলামি রাষ্ট্রে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী গঠিত হবে। যাকাতের বিপরীতে জিজিয়া অমুসলিমদের জন্যে একটা সিভিক ডিউটি বা সিভিক কন্ট্রিবিউশন। জিজিয়া কোনো বাড়তি চাপ বা শাস্তিও নয়, অমুসলিমদেরকে ছোট করাও নয়। মওদূদী (রহিমাহুল্লাহ) জিজিয়াকে ইসলামি রাষ্ট্রে তাদের নাগরিক দায়িত্ব ও চুক্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।
এভাবে, লিবারেলিমজম ও ন্যাশনালিজমের বাইরে গিয়ে ইসলামী ভাবসম্পদ ব্যবহার করে মওদূদী (রহিমাহুল্লাহ) ইসলামী রাষ্ট্রের পলিটির ডিকলোনাইজড ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। পশ্চিম লিবারেলিজমকে একটা ইউনিভার্সাল ক্যাটেগরি আকারে হাজির করে। মওদূদী (রহিমাহুল্লাহ) দেখিয়েছেন যে, পশ্চিমা রাষ্ট্রতত্ত্বের ইকুয়ালিটির ধারণা যদি অকার্যকর হয়ে থাকে, যদি তা ঔপনিবেশিক অধস্তনতাকে স্বাভাবিক করে থাকে, তবে এই ‘ইকুয়ালিটি’র ধারণাকে সর্বোৎকৃষ্ট সার্বজনীন বর্গ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। অন্যদিকে, ইনইকুয়ালিটিকে লিবারেল রাষ্ট্রতত্ত্ব নেতিবাচক হিসেবে দেখে, কিন্তু মওদূদী (রহিমাহুল্লাহ) এটাকে ন্যায়েরই এক ভিন্ন রকম তত্ত্ব হিসেবে ব্যাখ্যা করেন মওদূদী, যেখানে একটা রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর দুটো অংশের ভেতরে আনুগত্যের ভিন্ন ভিন্ন বেইজ বা ভিত্তি থাকে, কিন্তু নিরাপত্তা, মর্যাদা ও স্বাধীনতা সবার জন্যই নিশ্চিত করা হয়। মওদূদী দেখিয়েছেন যে, আধুনিক রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্যাটেগরিকে ইসলামের ভাবসম্পদ ব্যবহার করে রিথিংক করা যায়। হুমাইরা ইক্তিদার জিজিয়ার পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলেন নি বা মওদূদীর ভাষ্যকে ইউরোপীয় রাষ্ট্রদর্শনের সুপেরিয়র অল্টারনেটিভও ভাবেননি, বরং কলোনিয়াল মডার্নিটির ফাঁকফোঁকর দেখিয়ে মওদূদী (রহিমাহুল্লাহ) কীভাবে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’র রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী গঠনের প্রক্রিয়া আলোচনা করেন সেটির দিকে বিশ্লেষণী নজর দেন।
এভাবে হুমায়রা ইক্তিদার মওদূদী (রহিমাহুল্লাহ)-র রাষ্ট্রভাবনাকে চিত্রায়িত করেছেন।
Leave a comment