Home History বাংলা, বাঙালি ও মুসলিম পটভূমি বিকাশের পথরেখা
History

বাংলা, বাঙালি ও মুসলিম পটভূমি বিকাশের পথরেখা

Share
Share

[পরিমার্জিত]

[ভিডিও লিংক: বাংলা, বাঙালি ও মুসলিম পটভূমিঃ বিকাশের পথরেখা – শায়খ মুসা আল হাফিজ]

আমাদের আজকের যে আলোচনা, তা বাঙালির শেকড়, আত্মপরিচয়, মুসলমানদের সাথে বাংলার পরিচয় নিয়ে। আমরা এমন একটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি যা অনেকের কাছে একাডেমিক বিষয়। তাদের মনে হবে যে, এ ধরনের আলোচনা তো আমাদের একাডেমিয়াতে হয়। অনেকের কাছে মনে হবে যে, না! এটি তো পাঠ্যপুস্তক সংলগ্ন আলোচনা। আমরা যখন বিষয়টিকে এইভাবে দেখব, তখন তার গভীরে ঢুকতে ব্যর্থ হব। 

 আপনাকে মনে রাখতে হবে যে, পাঠ্যপুস্তকও আপনাকে প্রতাারিত করতে পারে। পাঠ্যপুস্তক অনেক সময় বিজয়ীদের হাত দিয়ে রচিত হয় যারা রাজনীতি,সংস্কৃতি,অর্থনীতি ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই নিয়ন্ত্রণ সবসময় যথার্থ এবং ইনসাফ সম্মত প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় না, জবরদস্তির মধ্য দিয়েও হয়। ফলে পাঠ্যপুস্তক সবসময় সত্য উচ্চারণ করে না, বরং অনেক সময় নতুন সত্য নির্মাণ করবার চেষ্টা করে এবং তার হাত দিয়ে নির্মিত সেই সত্য-উপলব্ধি অনেকটা ক্ষমতাসীনদের আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের রাজনৈতিক অভিলাশের অনুকূলে কাজ করে। ফলে পাঠ্যপুস্তক মাত্রই বিচার বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

  আমাদের দেশে কিংবা অন্যত্র ‘পাঠ্যপুস্তকীয় সত্য’ বলে একটি কথা আছে। এই সত্যটাকে অনেক সময় সত্যের অপলাপ হিসেবে দেখা দরকার এবং তার অনুশীলনও করা উচিত। আমরা যে আলোচনা করতে যাচ্ছি, তা ইতিহাসকে খনন করবার চেষ্টা, বাস্তবতাকে একটু তলিয়ে দেখবার চেষ্টা। আপনারা দেখবেন যে, আমরা যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছি তা অনেকের কাছে এক ধরনের অপরাধমূলক আলোচনা বা অপরাধমূলক কর্মের ধারাবাহিকতা। কেন? দীর্ঘ সময় ধরে প্রচলিত ন্যারেটিভের কারণে।

  আরএসএস এর প্রধান মোহন ভগবত; তিনি বলেছেন যে, ভারত উপমহাদেশে অনেকেই উপনিবেশ তৈরির চেষ্টা করেছেন। (যেমন: ব্রিটিশরা তৈরি করেছে, ফরাসিরা তৈরি করেছে এবং ব্যর্থ হয়েছে; ওলন্দাজরা তৈরি করার চেষ্টা করেছে এবং ব্যর্থ হয়েছে। আমরা সবাই বলি যে, ব্রিটিশরা উপনিবেশ তৈরি করেছে এবং সেই উপনিবেশ চলে গেছে; এটিই সত্য কথা যে, তারা বিদায় নিয়েছে। কিন্তু) মোহন ভগবত বলছেন যে, আরেকটা উপনিবেশ আছে যেটি বিদায় নেয়নি। সেই উপনিবেশ তৈরি হয়েছিল ৭১৫ ও ১১৯৫ সালে। ব্রিটিশরা উপনিবেশ তৈরি করেছিল, অতঃপর চলে গিয়েছে। তারা এখন আমাকে শাসন করবার জন্য, আমার সংস্কৃতিকে লুট করবার জন্য, আমার ওপর সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবার জন্য কিংবা আমার আকারকে নিজস্ব অভিপ্রায় অনুযায়ী গড়ে তোলবার জন্য এখানে অনুপস্থিত। কিন্তু আরেক দল আছে যারা উপনিবেশ তৈরি করেছিল এবং চলে যায়নি। তারা তাদের ভাষা,সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের চারপাশে রয়ে গেছে; তারা হচ্ছে মুসলমানেরা।

ওপরের এই ন্যারেটিভ প্রবলভাবে সমাজে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সিনেমা,নাটক,মিডিয়া ইত্যাদি দিয়ে; এমনকি পাঠ্যপুস্তক এবং তত্ত্ব নির্মাণের প্রক্রিয়াতেও। আপনি হয়তো জানেন না, হয়তো আপনার কাছে সোচ্চারভাবে সেটিকে হাজির করা হয় না, প্রচ্ছন্নভাবে এই কথাটি ইনিয়ে বিনিয়ে বলা হয়,কিন্তু ভারতে তা সোচ্চার ভাবেই হচ্ছে। এটি মূলত কোনো প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক বক্তব্য নয়, বরং সেখানে হোয়াট্সঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি আছে এবং সেখানে ইতিহাস নির্মাণ করা হয়, সাজানো হয়। অর্থাৎ, আরএসএস এর ন্যারেটিভটিকে ইতিহাস হিসেবে দাঁড় করাবার চেষ্টা করা হয়। এটি বাচ্চাদেরকেও শেখানো হয়, ফলে তারা রাগান্বিত,উত্তেজিত,ঘৃণাপূর্ণ মানসিকতা নিয়ে বড় হয়। তাদের বলা হয় যে, আমাদের চারপাশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এমন সব লোকেরা যারা আমাদেরকে উপনিবেশে পরিণত করেছিল এবং ওদেরকে বিতাড়িত করতে হবে, তাহলেই আমাদের স্বাধীনতা পূর্ণ হবে।

  ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ভারতের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বললেন যে, হাজার বছরের পরাধীনতার অবসান হয়েছে। আমরা তো জানি যে, উপমহাদেশের পরাধীনতা হাজার বছরের নয়; কিন্তু এটিই হচ্ছে আরএসএস এর ন্যারেটিভ। তারা মুসলিম আগমনকে ঠিক ঐ দখলদারিত্ব হিসেবে দেখাতে চায়, যে দখলদারিত্ব হিসেবে আমরা লর্ড ক্লাইভের আগমনকে বা তাদের কোম্পানির বাংলা জয়কে দেখি। ফলে এই জায়গা থেকে আমাদের বিষয়টির সাথে মোকাবেলা করতে হবে। 

ব্যাপারটি কি আদৌ এরকম যে, আসলেই মুসলমানরা এখানে এসে কোনো উপনিবেশ কায়েম করেছিলেন? এবং উপনিবেশের চরিত্র কি সেখানে ছিল? উত্তর হচ্ছে, “না।” আমরা গোটা ভারত উপমহাদেশ নিয়ে আলোচনা করব না; কিন্তু যদি আমরা বাংলাকে বিচার-বিশ্লেষণ করি, তাহলে আমাদের দেখতে হবে যে, এখানকার প্রেক্ষাপটে মুসলিম আগমন, মুসলিম সংস্কৃতির বিকাশ, ইসলামের প্রচার-প্রতিষ্ঠা- এই সমস্ত কিছু আসলে কোন প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালি পরিচয়, বাঙালিত্ব, বাংলা ভাষা-সাহিত্য- এগুলো কি ক্ষুণ্ণ হয়েছে নাকি বিকশিত হয়েছে? সেটি বিব্রত হয়েছে নাকি উৎফুল্ল হয়েছে? সেটি সুরক্ষিত হয়েছে নাকি সেটি কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে? এই ব্যাপারগুলোর মধ্য দিয়ে আমাদের আলোচনাটি সামনের দিকে নিয়ে যেতে হবে।

  মোহন ভগবতের প্রসঙ্গে অনেকেই বলতে পারেন যে, “আরে! তিনি তো একজন প্রপাগান্ডিস্ট এবং পলিটিক্যাল ন্যারেটিভের একজন প্রচারক।” কিন্তু এই ব্যাপারটা মোহন ভগবতের বয়ানে আসার আগে অন্তত দেড়শত বা দুইশত বছরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটি আর্টিকেল লিখেছিলেন ‘বাঙালির উৎপত্তি’ নামে, তাতে তিনি লিখেছেন যে, ইংরেজরা এক জাতি, বাঙালিরা বহু জাতি। (ইংরেজরা একজাতি এই কথাটাও সঠিক না। আপনি যদি ব্রিটেনের ইতিহাসের দিকে তাকান, তাহলে দেখবেন যে, তারা বহুত্বের মধ্য দিয়েই এই জায়গায় এসেছে।) বঙ্কিমের মতে বাঙালিরা অন্তত চার জাতি। আর্য, সনাতনী হিন্দু, আর্য-অনার্য হিন্দু (আর্য এবং অনার্যের মিথষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যে মানুষগুলো ধর্মে হিন্দু)- এই তিন জনগোষ্ঠী হচ্ছে প্রথম তিন স্তরের বাঙালি। আর চতুর্থ স্তরের বাঙালি হচ্ছে মুসলমানেরা। বঙ্কিম বলছেন যে, বাঙালির ইতিহাস মূলত আর্যদের বিকাশ এবং অগ্রগামিতার ইতিহাস। তিনি ইতিহাসের নতুন বয়ান প্রস্তাব করলেন যে, এটি বাঙালি রেনেসাঁ। এই বয়ানটিকে গ্রহণ করল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ,পন্ডিতেরা এবং পাঠ্যপুস্তকসমূহ।

আমাদেরকে তারা ভুল বয়ান শিখিয়েছে; বলেছে যে, বাঙালি রেনেসাঁ মানে কলকাতার রেনেসাঁ। সেটি আদৌ বাঙালির রেনেসাঁ ছিল না, বরং তা ছিল কলকাতার নতুন জন্ম নেয়া বাবু-বুদ্ধিজীবী-মধ্যবিত্ত শ্রেণির রেনেসাঁ, যা তাদের সমাজের জন্য দরকারি ছিল। যেমন: সেখানে সতীদাহ প্রথার বিলোপ ঘটানো হয়েছে, বিধবা বিবাহ প্রবর্তন করা হয়েছে। মুসলিম সমাজে (পূর্ববঙ্গ) তো আগে থেকেই সতীদাহের ব্যাপারটা ছিল না, বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ করবার ব্যাপার এখানে ছিল না, তাহলে এটি কীভাবে বাঙালির রেনেসাঁ হবে? কলকাতার যে রেনেসাঁ, তা ইউরোপীয় রেনেসাঁকে একটি হিন্দু অবয়ব দিয়ে উচ্চবর্ণের সনাতনী আকাঙ্ক্ষার আলোকে এটিকে ঐ ভূমিতে (পশ্চিমবঙ্গ) প্রতিষ্ঠিত করবার কামনা করেছে। 

সেই রেনেসাঁয় এই পূর্ববঙ্গের কৃষক, পূর্ববঙ্গের গ্রামে বসবাসকারী নাগরিক, পূর্ববঙ্গের জনতার হাজার বছরের যে বোধ, বিশ্বাস, জীবনানুশীলন- এগুলোর কোনো প্রতিনিধিত্ব, প্রতিফলন কিংবা তাদের সংকট, জিজ্ঞাসা এবং জিজ্ঞাসার সদুত্তর দেবার কোনো চেষ্টা ছিল না। ফলে এটিকে বলা যায় একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির রেনেসাঁ, উচ্চ বর্ণের বাবু-বুদ্ধিজীবীদের আনিত রেনেসাঁ। এটি আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতিনিধিত্ব করে না, এই পূর্ববঙ্গ ভূমির প্রতিনিধিত্ব করে না। উল্টো আমরা প্রশ্ন করতে পারি যে, ঐ রেনেসাঁর বুদ্ধিজীবীরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে কীভাবে চিত্রায়িত করেছেন?

তাদের ভাষ্যের মধ্যে আমরা যা পাই তা হল: নীরদচন্দ্র চৌধুরী লিখেছেন যে, তারা এখানকার মুসলিম চাষাদেরকে গৃহপালিত পশুর চেয়ে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন না। ফলে ঐ রেনেসাঁ আমাদেরকে গৃহপালিত পশুর জায়গায় রেখে বাঙালিত্বের ব্যাখ্যা করেছে। এই ব্যাখ্যা যখন কট্টরভাবে হাজির হয়েছে, তখন সে আমাদের জন্য বরাদ্দ রেখেছে বাঙালিত্ত্বের চতুর্থ স্তরটা। অর্থাৎ, মুসলমানদেরকে অপর (Other) হিসেবে দেখানোর যে ধারাবাহিকতা, তার বয়স অন্তত দুই শতাব্দী। দুই শতাব্দীর ধারাবাহিকতা একে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।

  এখন প্রথমে এটি ঘটেছে গবেষণার পরিসরে, ইতিহাস নির্মাণের পরিসরে; তারপরে সাংস্কৃতিক বয়ান হিসেবে; তারপরে একাডেমিয়ায়; তারপরে এটি সমাজে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করেছে; তারপরে রাজনৈতিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে এবং মোহন ভগবত ও নরেন্দ্র মোদির ভাষ্য হয়েছে। ফলে যখন নরেন্দ্র মোদি এই কথা বলছেন, তখন তিনি মূলত সেই দুই শতাব্দীর ধারাবাহিকতার প্রতিনিধিত্ব করছেন।

আপনার পাঠ্যপুস্তকের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় এই জিনিসটি দেখতে পাবেন। এমনকি বিগত রেজিমের সাথে আমরা যে লড়াইগুলো করেছি, সেসব লড়াইয়ের অন্যতম একটি বিষয় ছিল- পাঠ্যপুস্তকে তারা হিন্দুত্ববাদী ন্যারেটিভ পুনর্গঠন করেছেন এবং সেখানে মুসলিমদের দখলদার হিসেবে,মুসলিম সংস্কৃতিকে বহিরাগত সংস্কৃতি হিসেবে এবং মুসলিম জীবনানুশীলনকে একটি চাপিয়ে দেওয়া বিষয় হিসেবে তারা হাজির করবার জন্য অনবরত নানা মেটাফোর তালাশ করেছেন, প্রচ্ছন্নভাবে বলার চেষ্টা করেছেন কিংবা কোথাও প্রকাশ্যেও বলেছেন। অর্থাৎ, জুলাই ‘বিপ্লব’ যখন লড়ে, তখন তা কার সাথে লড়ে? জুলাই ‘বিপ্লব’ কেবল তার সাথে লড়ছে না যিনি ক্ষমতার কেন্দ্রে দৃশ্যমান আকারে বসে আছেন, বরং সেই ন্যারেটিভের সাথে সে লড়ছে, যে ন্যারেটিভ দাঁড়ি-টুপির কারণে একজনের সংস্কৃতিকে বহিরাগত হিসেবে দেখায় এবং তার ওপর নিপীড়ন কে বৈধতা দেয়।

  যখন বঙ্কিম বোঝাচ্ছেন যে, বাঙালির ইতিহাস আসলে আর্যদের ইতিহাস, তখন তিনি সম্পূর্ণ মিথ্যাচার করছেন। আর্যরা কোথা থেকে আসলো? আর্যরা কি এই ভূমির আদিপুরুষ? মোটেও নয়। আপনারা দেখবেন যে, পাঠ্যপুস্তকে বাঙালির ইতিহাসের মধ্যে দেখানো হয় মৌর্য যুগ, গুপ্ত যুগ, সেন যুগ ইত্যাদিকে; এগুলোকে বাঙালির গৌরবময় যুগ হিসেবে দেখানো হয়। একইসাথে আর্য পূর্ব যে সময়কাল, তা মিনিমাইজ করা হয়। সেখানে অস্ট্রিক,নেগ্রিটো,দ্রাবিড়- এদের কারো বিবরণী নেই, নামমাত্র তা উল্লেখ করা হয় এবং এদের সাথে সম্পর্কিত আমাদের কোনো যোগসূত্রকে সেখানে হাজির করা হয় না। কিন্তু আমাদের নৃতাত্ত্বিক গঠনকে যদি আমরা ব্যাখ্যা করি, তাহলে চোখ, কপাল, মাথার খুলি, কান, গাত্রবর্ণ, শারীরিক উচ্চতা ইত্যাদি গঠনগত দিক দিয়ে আর্য পরবর্তী সময়কালের চেয়ে আর্য পূর্ববর্তী সময়কালের সাথে আমাদের মিল বেশি। 

আরো সুনির্দিষ্ট অর্থে, বাঙালি জাতিকে যদি আপনি ব্যাখ্যা করেন, তাহলে দেখা যায়, বাঙালিরা হচ্ছে ভেড্ডিড রক্তধারার উত্তরসূরী। ভেড্ডিড হচ্ছে মূলত অস্ট্রোলয়েড, যারা এখানে প্রথম দিকে বসতি নির্মাণ করেছিল, এই ভূমি আবাদ করেছিল। আমাদের নগর তৈরির মধ্যেও তাদের ছাপ আছে। দ্রাবিড়রা প্রথমত নগর সভ্যতার দিকে ঝুঁকতেন আর অস্ট্রিকরা গ্রামীণ সভ্যতার দিকে ঝুঁকতেন। পরবর্তীতে আমাদের গ্রামগুলো অস্ট্রিক উত্তরাধিকারকে বহন করতো আর আমাদের শহরগুলো দ্রাবিড় উত্তরাধিকারকে বহন করতো। আরো বৃহত্তর অর্থে, আমাদের গায়ে, আমাদের ভাষায়, আমাদের সকল কিছুর মধ্যে যারা নিজেদের হস্তলিপি রেখে গেছে তারা হচ্ছেন অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী।

  তাহলে এই ভূমির আদিবাসী কি আর্যরা? এই প্রশ্ন নিয়ে এখন আমরা আলোচনা করব। ব্রিটিশরা যখন সবেমাত্র এসেছে এবং এখানে ক্ষমতা বিস্তার করছে, তখন গোলাম হোসেন সালিম ‘রিয়াজুস সালাতিন’ নামক একটি ইতিহাসের বই লিখেছিলেন। সেখানে তিনি আলোচনা করেছেন যে, বাঙালিরা কীভাবে আসলো? তিনি বলছেন যে, হযরত নূহ আলাইহিস সালামের এক পুত্র হলেন হাম, হামের এক পুত্র হলেন সিন্ধ। সেই সিন্ধের নামে ভারত উপমহাদেশ হয়েছে হিন্দ। সিন্ধের অনেক পুত্র ছিলেন, এর মধ্যে দুই নম্বর পুত্রের নাম ছিল বং, যার নামে এই ভূমির নাম হয়েছে ‘বঙ্গ।’ গোলাম হোসেন সালিম এই বিবরণী দিয়েছেন তুরাস থেকে। তুরাস হলো আমাদের জ্ঞান চর্চার পরম্পরা, আমাদের ইতিহাস চর্চার পরম্পরা। যারা সেমেটিক ভাষাগুলো ব্যাখ্যা করেন, জাতিত্ব ব্যাখ্যা করেন, তারাও কিন্তু নূহ আলাইহিস সালাম পর্যন্ত যান। ইসলাম ধর্ম,ইহুদি ধর্ম, খ্রিষ্ট ধর্ম- সব জায়গাতেই নূহ আলাইহিস সালামকে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং তাঁর সন্তানেরা যে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছেন, তা-ও স্বীকৃত। কিন্তু আমাদের দেশের একজন বিচারপতি এবং ইতিহাসবিদ হাবিবুর রহমান বলতে চান যে, এ জাতীয় বক্তব্যের আদৌ কোনো সত্য মূল্য নেই, কারণ হিন্দু পুরাণের মধ্যে এ বিষয়ে ভিন্ন কথা আছে।

  হিন্দু পুরাণ হচ্ছে হিন্দু ধর্মীয় সাহিত্যের একটি দিক। আবার, তাদের ধর্মীয় সাহিত্যের আরেকটি দিক হচ্ছে মহাকাব্য, যেমন: রামায়ণ এবং মহাভারত। মহাকাব্য ও পুরাণ কখনো ইতিহাস নয়। মহাকাব্য ও পুরান এবং ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য হলো: পুরাণের মধ্যে একজন মানুষের উচ্চতা মেঘ স্পর্শ করতে পারে, আকাশ স্পর্শ করতে পারে, একটি হনুমানের লেজ আড়াইশ হাত লম্বা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের মধ্যে হনুমানের লেজ বড়জোর দেড় হাত হবে। ফলে পুরাণকে ইতিহাস বানাতে হলে সেই আড়াইশ হাত লেজকে কেটে কেটে দেড় হাতে নিয়ে আসতে হয়। তাই পুরাণকে পৃথিবীর কোনো হতভাগা ইতিহাস বলে না। মহাকাব্যের উৎস হচ্ছে কল্পনা আর ইতিহাসের উৎস হচ্ছে বাস্তব জীবন। 

  যাই হোক, মহাভারতের মধ্যে আছে যে, রাজা বলির পাঁচ পুত্র ছিলেন; এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন অঙ্গ, একজন হচ্ছেন বঙ্গ, আরেকজন হচ্ছেন কলিঙ্গ ইত্যাদি; এদের মধ্যে বঙ্গ এই ভূমি জয় করেছেন, তাই এই ভূমির নাম হয়েছে বঙ্গ। অনেকে যে দাবি করেন যে, চট্টগ্রাম বা এই বাংলা হিন্দুদের, তারা মূলত এই প্রেক্ষিতেই এহেন দাবি করে থাকেন। এখন, বিচারপতি হাবিবুর রহমান বললেন যে, হিন্দু পুরাণ যেভাবে কল্পনা চর্চা করেছে, মুসলিম পুরাণও তেমনি কল্পনা চর্চা করেছে। হিন্দু পুরাণ বলেছে যে, রাজা বলির পুত্র বঙ্গ এই ভূমি জয় করেছিলেন আর মুসলিম পুরাণ বলছে যে, নূহ আলাইহিস সালামের বংশধররা এখানে এসেছিলেন। 

  এই যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতারণা এবং অসততা- আমাদের মাঝে এই জিনিসটি ধরতে পারবার দৃষ্টি জন্ম দিতে হবে। তিনি যা করেছেন, তা হলো ফ্যালাসির সর্বনিম্ন স্তর: এমন কিছুর সাথে অন্য একটি জিনিসের তুলনা করা যার সাথে আদৌ কোনো তুলনা চলে না। হযরত নূহ আলাইহিস সালাম ঐতিহাসিক চরিত্র কিনা? এটি সারা বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন ভাবে স্বীকৃত সত্য কিনা? এখন হযরত নূহের আলাইহিস সালামের সন্তানেরা ছড়িয়ে পড়েছিলেন দুনিয়া জুড়ে, এটি ঐতিহাসিক বক্তব্য কিনা? সবগুলো প্রশ্নের উত্তর হলো, “হ্যাঁ।” ফলে এই সন্তানেরা ছড়িয়ে পড়েছিলেন এবং ভারত উপমহাদেশে এসেছিলেন, এটি একটি প্রবল সম্ভাবনা, তাই না? হ্যাঁ, ঐতিহাসিকভাবে প্রবল সম্ভাবনা, বাস্তবতার দাবি, পুরাণের মতো কল্পনা নয়। তিনি এই বয়ানটাকে তুলনা করলেন এমন একটি বয়ানের সাথে যার ইতিহাসের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। 

  এই ধরনের অসৎ বুদ্ধিবৃত্তি আমাদেরকে সবসময় ঘুম পাড়ানো গল্প শুনিয়েছে। অর্থাৎ, আপনার আত্মজিজ্ঞাসা যাতে ঘুমিয়ে থাকে, আপনি যাতে একবার জেগে উঠে অনুসন্ধান না করেন যে, আমাকে যা শোনানো হচ্ছে, তা আদৌ সত্য কিনা তা একবার যাচাই করে নেই। এই জাতীয় ঘটনাগুলো আপনার ক্লাসরুমেও হচ্ছে, পাঠ্যপুস্তকেও হচ্ছে এবং উপন্যাসের-গল্পের মধ্যেও হচ্ছে। উপন্যাস-গল্পের মধ্যে যা হয়, তা আরো গভীর অর্থে কাজ করে। ভারত এই হিন্দুত্ববাদী ন্যারেটিভ তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি চলচ্চিত্র, নাটক ইত্যাদির সহায়তা নিচ্ছে।

এখন তর্কের খাতিরে আমরা যদি ধরেও নিই যে, বঙ্গভূমির ইতিহাস নিয়ে এই দুই ধারার গ্রহণযোগ্যতা একই, তাহলে মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী, বঙ্গ এই ভূমি জয় করেছেন; কিন্তু ‘রিয়াজুস সালাতিন’-এর বক্তব্য অনুযায়ী, নূহ আলাইহিস সালামের সন্তানেরা, অর্থাৎ, তাঁর সন্তান হাম, তাঁর সন্তান সিন্ধ,তাঁর সন্তান বং এই ভূমি আবাদ করেছেন। জয় করা এবং আবাদ করা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

  কোনো ভূমি যে প্রথমবার আবাদ করে, তাকে বলে আদিবাসী আর জয় করা মানে পরে এসে দখল করা। অর্থাৎ, হিন্দু পুরাণকে ঐতিহাসিক মূল্য দিয়েও আমরা দেখলাম তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে যে, নূহ আলাইহিস সালামের বংশধররা এই ভূমি আবাদ করেছিলেন আর মহাভারতে বর্ণিত ঐ বঙ্গ এসে দখল করে দখলদার হিসেবে থাকছেন। ‘রিয়াজুস সালাতিন’- এর ভাষ্য একমাত্র ভাষ্য নয়, বরং আমরা সমস্ত ভাষ্যকে সামনে নিতে চাই। যেমন: মোল্লা ফয়জী একটি ভাষ্য দিয়েছেন যে, এটি ছিল বঙ্গ,এখানে ক্ষেতের প্রয়োজনে প্রচুর পরিমাণে আল তৈরি করা হতো, যার ফলে এই ‘বঙ্গ’ এর সাথে ‘আল’ যুক্ত হয়ে ‘বঙ্গাল’ হয়েছে- ইত্যাদি অনেক ধরনের বক্তব্য আছে।

  এখন আমরা যদি এই বঙ্গ সভ্যতার সাথে আর্যদের মিল দেখতে চাই, তাহলে তা কোথায় পাচ্ছি? এই মিল আমরা প্রথম যেখানে দেখতে পাচ্ছি তা হলো মহাভারত; এটি আমাদেরকে জানাচ্ছে যে, রাজা বলির পুত্র এসে বাংলা জয় করেছেন। ব্যাস, এটিই প্রথম বর্ণনা। এর আগের বর্ণনাগুলো কীরকম? মহাভারত কিন্তু বৈদিক সাহিত্যের প্রথম দিকের সাহিত্য না। বৈদিক সাহিত্যের প্রথম দিকের সাহিত্য হচ্ছে বেদ। বেদের মধ্যে সবার আগের সাহিত্য হচ্ছে ঋগবেদ। বৈদিক সাহিত্যের প্রথম দিকের সাহিত্য বাংলাকে কখনো প্রশংসা করে না, বাংলাকে তিরস্কার করে, নিন্দা করে, এই ভূমিকে অভিশপ্ত ভূমি হিসেবে দেখায়।

  প্রথমদিকের বৈদিক সাহিত্যের একটি গ্রন্থ হচ্ছে ঐতরেয় আরণ্যক। এটি আমাদেরকে জানাচ্ছে যে, যে ভূমিগুলো দেবতার অভিশাপে ধ্বংস হয়েছিল, তাদের মধ্যে প্রথম জনপদটার নাম হচ্ছে বঙ্গ। আরেকটি প্রথম দিকের গ্রন্থ হচ্ছে ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, যা জানাচ্ছে: বঙ্গের যে জনগোষ্ঠী, তারা হচ্ছে ইতর শ্রেণিভুক্ত। তারা অরণ্যে বসবাসকারী পাশব পর্যায়ের মানুষ, তাদের ভাষাটা হচ্ছে চিড়িয়ার (পাখি) ভাষা; অর্থাৎ, কোনো সভ্যতাকে সে বহন করে না। এই যে প্রথম দিকের বৈদিক সাহিত্য কখনো বঙ্গকে আদৌ ভালোরূপে নিতে পারছে না, সবসময় তিরস্কার করছে, নিন্দা করছে, ঘৃণা করছে, দেবতা পরিত্যক্ত হিসেবে দেখাচ্ছে, এর কারণ কী? এর কারণ জানতে হলে আমাদের জানতে হবে বৈদিকদের বা আর্যদের ইতিহাস।

  আর্যরা এসেছিল কোথা থেকে? আর্যরা এসেছিল ককেশাস অঞ্চল থেকে। তারা উড়াল পর্বতের আশেপাশে বসবাস করতো। আর্যদের পূর্বপুরুষরা কোথায় বসবাস করতো- তা নিয়ে অনেক ধরনের কথাবার্তা আছে। সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য মত এটি। তারা ছিল যাযাবর প্রকৃতির। তারা পশুপালন করতো এবং জঙ্গলের মধ্যে শিকার করতো। যারা এই ধরনের কাজ করে পাহাড়ে-মালভূমিতে বসবাস করে, তাদের চরিত্রের মধ্যে এক ধরনের যোদ্ধা ও হিংস্র প্রকৃতি থাকে। 

  তারা এখানে প্রবেশ করলো ভারত উপমহাদেশের উত্তরপূর্ব সীমান্ত হয়ে; অর্থাৎ, আফগানিস্তান-পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চল হয়ে। এই ভূমিতে প্রবেশ করে প্রথম যে কাজটা তারা করেছিল তা হল: হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতাকে তারা ধ্বংস করা। এই দুই সভ্যতা নির্মাণ করেছিল দ্রাবিড়রা, ধ্বংস করেছে বহিরাগত আর্যরা। আমাদের বিগত রেজিম পাঠ্যপুস্তকে আমাদেরকে এই গল্প শুনিয়েছে যে, হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতা নির্মাণ করেছিল আর্যরা। গোটা ঘটনাটাই উল্টে দেয়া হয়েছে। 

  আর্যরা এসে প্রথমে উত্তর-ভারত অঞ্চল দখল করে নিল। দ্রাবিড়রা যে কেবলমাত্র বাংলায় ছিল, তা কিন্তু না। তামিল ভাষা, তেলেগু ভাষা, মালায়ালাম ভাষা- এগুলো সব দ্রাবিড়দের ভাষা। অর্থাৎ, ভারতের সেই অংশেও আর্যদের পূর্বে দ্রাবিড়রা বাস করত। বাংলা ভাষাতেও দ্রাবিড় ভাষার প্রচুর শব্দাবলী এখনো রয়ে গেছে। এভাবে আর্যরা উত্তর-ভারত দখল করতে করতে যখন বাংলায় প্রবেশের চেষ্টা করেছিল পূর্ব সীমান্ত দিয়ে, তখন এখানে তারা প্রবল-প্রচন্ড-তীব্র ও ধারাবাহিক প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। বারবার এই অঞ্চলগুলো দখল করবার জন্য তারা চেষ্টা করেছে; যতবার চেষ্টা করেছে, ততবার-ই তারা পরাজিত হয়েছে। 

  তাদের দখলকৃত অংশের নাম ছিল আর্যাবর্ত, আর্য-দের পবিত্র ভূমি, যার সীমান্তের শেষ জায়গাটা হচ্ছে করতোয়া নদী, এটিকে তারা বলতো সনানিত নদী। এরপরের অংশটা আর্যাবর্ত সীমান্তের বাইরে। আমাদের জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী লড়াইটা ছিল আর্যদের বিরুদ্ধে। আমরা একাত্তর সালে যুদ্ধ করেছি নয় মাস, কিন্তু আর্যদের বিরুদ্ধে আমাদেরকে যুদ্ধ করতে হয়েছে কমপক্ষে পাঁচশত বছর। এই যুদ্ধের কথা বেমালুম অস্বীকার করা হতো, এখনো করা হয়। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই এজন্য যে, ঐ সময়ের আর্য সাহিত্য ঐ যুদ্ধের স্বাক্ষর নিজের গায়ে রেখে দিয়েছে। ফলে নিহার রঞ্জন রায়ের মতো ইতিহাসবিদদেরও এটি স্বীকার করতে হয়েছে যে, বঙ্গভূমিকে আর্যরা সবসময় তিরস্কার করেছে, অভিশপ্ত হিসেবে দেখেছে।

  যেকোনো লড়াই জারি রাখবার জন্য আদর্শের দরকার আছে। আদর্শ নেই এবং লড়াই চলছে, এইরকম লড়াই বেশিদিন চলবে না, কারণ সেক্ষেত্রে আপনি একটি পরাজিত ময়দানে লড়ছেন। আপনাকে প্রথমত একটি আদর্শকে বহন করতে হবে এবং এই আদর্শের জমিতে দাঁড়িয়ে আপনাকে লড়তে হবে। তৎকালীন বঙ্গের মানুষ আর্যদের আগ্রাসনের বিপরীতে লড়বার জন্য বৌদ্ধ ধর্মকে আপন করে নিল। বৌদ্ধ ধর্ম ছিল বৈদিক-আর্য ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ। বৈদিক ধর্ম সবসময় যে জিনিসটা চাইতো, সেটি হলো: যাগযজ্ঞ বলিদান। এই প্রবণতা ভয়াবহ আকার লাভ করেছিল। ফলে গৌতম বুদ্ধ জীবে দয়া করার কথা বললেন এবং বলিদানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিল।  আর্যদের সেই ধর্মে পশু হত্যা করা হতো, গরু জবাই করা হতো। ফলে সনাতনী ধর্ম একটি আর বর্তমানে বিদ্যমান হিন্দু ধর্ম আরেকটি। সনাতনী ধর্ম, যেটি সনাতন মানে প্রাচীনতম, সেই সনাতনী ধর্মের মধ্যে পশু জবাই করার ব্যাপারটা আছে এবং গরু যে জবাই করা হতো, সেই ব্যাপারটিও আছে। পৌরাণিক যুগের পরে মহাকাব্যের যুগে এসে তারা এই জবাইয়ের ব্যাপারটা থেকে সরে আসতে শুরু করে। 

আর্যদের বিরুদ্ধে আরেকটা আদর্শিক বিদ্রোহ ছিল জৈন ধর্ম। মহাবীর এখানে এসে জৈন ধর্ম প্রচার করল, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সে ধর্মকে আপন করে নিল, কারণ বৈদিক-আর্য সংস্কৃতি এবং দর্শনের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য তাদের একটি আদর্শিক হাতিয়ারের দরকার ছিল। পরবর্তীতে এই বঙ্গের স্থানীয় বৌদ্ধরাই ইসলাম গ্রহণ করেছে। 

  আমরা আর্যদের নিয়ে এত কথা কেন বলছি? আমাদেরকে বাধ্য করছেন বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিম বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, বাঙালির ইতিহাস মানে হচ্ছে আর্যদের ইতিহাস। পূর্বের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। এই আলোচনাগুলো ইতিহাসে আছে, ফলে নিহার রঞ্জন,রাখাল দাস- এর মতো অন্যান্য ইতিহাসবিদগণও এ সত্যকে অস্বীকার করতে পারছেন না। কারণ বৈদিক সাহিত্যে এর ভুরি ভুরি প্রমাণ বিদ্যমান। এখন এই আলোচনাগুলো শুনলে এগুলোকে কোনো এলিয়েনের আলোচনা মনে হতে পারে, কারণ অনবরত একটি মিথ্যা আমাদের শোনানো হয়েছে এবং এর মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যাবতীয় ম্যাস কিলিং, অনাচার, অধিকার হরণ ও সব ধরনের বৈষম্যের বৈধতার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। 

“গতকাল তোমরা হিন্দুদের হত্যা করেছো, তোমাদের শক্তি ছিল; আজ আমাদের শক্তি, আমরা তোমাদেরকে হত্যা করব। গতকাল তোমরা মন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়েছো; আজ আমরা মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির বানাবো।” এই যে গতকালের সাথে আজকের যোগসাধন, এটি নিশ্চিত হয়েছে ন্যারেট করার ফলে। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো: যখন এইসব ন্যারেট করা হচ্ছিল, তখন আমরা লড়াই করিনি। ফলে অন্তত দেড়শ বছর পেছন থেকে আমাদেরকে এখন লড়তে হচ্ছে। 

আমাদের কিছু ইতিহাসবিদ তখন এর বিরুদ্ধে লিখেছেন, কিন্তু তা সমাজের একটি অগ্রসর অংশকে সেভাবে একাত্ম করেনি। ফলে এগুলোর পেছনে কোনো আন্দোলন ছিল না। একটি ন্যারেটিভের সামনে আন্দোলন থাকে। অর্থাৎ, ন্যারেশন হবে, পাশাপাশি সামাজিক জমিও তৈরি করা হবে এই ন্যারেশনের আলোকে এবং একটি অগ্রসর প্রজন্ম এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সামাজিক একটি মূল্যবোধের সাথে যুক্ত করে তুলবে, এর আলোকে আকাঙ্ক্ষা নির্মাণ করবে এবং পরবর্তীতে তা রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে নিজেকে প্রতিস্থাপন করবে। প্রত্যেকটা কাজের ধারাবাহিকতা আছে। আপনি সামাজিক কাজগুলো করছেন না অথচ বলছেন যে, রাজনীতিতে এর প্রতিফলন ঘটাবেন; এটি অবাস্তব।

  মুসলিমরা বহিরাগত,দখলদার- এই ন্যারেটিভ তৈরির পেছনে ব্রিটিশরা পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। যখন তারা দেখলো যে, মুসলমানেরা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করছে না, বরং প্রতিদিন তারা লড়ছে, তখন তারা কয়েকটা কাজ করল। প্রথমত, তারা ইতিহাস বিকৃত করল। ইতিহাস বিকৃতির এই কর্মযোগ্যের নেতৃত্ব দিয়েছে এশিয়াটিক সোসাইটি। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম দিকের পন্ডিতদের (যেমন: উইলিয়াম জোন্স) থেকে শুরু করে পরবর্তী পন্ডিতেরা ইতিহাসটাকে শুধু বিকৃত-ই করেনি, বরং যেখানে দরকার মনে করেছে, সেখানে নতুন করে গালগল্প তৈরি করেছে এবং তাকে ইতিহাস হিসেবে দাবি করেছে। যতটা না আমাদেরকে আমাদেরকে রক্তাক্ত করেছে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর লাঠি, তার চেয়ে বেশি আমাদের অস্তিত্বকে পদদলিত করেছে গবেষণাগারে বসে থাকা তাদের ইতিহাসবিদদের কলম। 

তারা আমাদের জীবনকে এই উপমহাদেশে অগ্রহণীয় করে তুলেছে এবং অপর করার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে এক প্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। তারা আমাদেরকেই বহিরাগত উপনিবেশ স্থাপনকারী হিসেবে দেখিয়েছে। আমরা লড়াই করেছি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে, কারণ তারা উপনিবেশ স্থাপন করেছে; এটি হলো আমাদের লড়াইয়ের প্রথম যুক্তি। ব্রিটিশ পন্ডিতেরা নারেটিভ বদলে দিল, বলল যে, আমরা প্রথম উপনিবেশ স্থাপনকারী নই। তোমরা যারা স্বাধীনতা চাও, তারাই আমাদের আগে উপনিবেশ স্থাপন করেছিলে। অসংখ্য গ্রন্থ তারা লিখেছে। বাংলার ইতিহাস, এরপর মধ্যপ্রদেশের ইতিহাস, উত্তরপ্রদেশের ইতিহাস, কর্ণাটকের ইতিহাস, দিল্লির ইতিহাস- এভাবে প্রত্যেকটা অঞ্চলের আলাদা আলাদা ইতিহাস তারা লিখেছে; মাটি খনন করে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বের করে নিজেদের ইচ্ছামত পাঠোদ্ধার করেছে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছে, ইচ্ছামত ন্যারেশন করেছে এবং এইভাবে আমাদেরকে ভারতীয় সত্তার বিরুদ্ধে, বাঙালি সত্তার বিরুদ্ধে, এখানকার ভূমিপুত্রদের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে একটি আগ্রাসী সত্তা হিসেবে হাজির করেছে। তাদেরই শাগরেদরা স্বাধীনতার পরে যখন আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ করল, তখন তাদের ন্যারেটিভটাকে সত্য বাক্য ধরে নিয়ে এটিকে পাঠ্যপুস্তকেও রাখল, এটিকে প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে আকার দিল এবং এর আলোকেই রাজনৈতিক নেতারা এখন কথা বলেন।

 দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশরা মুসলিম-হিন্দু বিভাজন তৈরি করল। মুসলিম আমলেও আদমশুমারি হতো। আদমশুমারি চালু করেছিলেন হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু, তাঁর আগে মদিনায় নবী আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম নিজে একটি আদমশুমারি করিয়েছিলেন। মুসলমানেরা আদমশুমারি করতেন, কিন্তু মুসলিম ও হিন্দু পপুলেশনকে আলাদা করে নয়। হিন্দু কতজন, মুসলিম কতজন- এই ভিত্তিতে না, বরং আদমশুমারি হতো কোনো গ্রামে মোট জনসংখ্যা কত, সেই ভিত্তিতে। ব্রিটিশরা ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পরে বড় ধরনের একটি ধাক্কা খেয়েছিল এবং এই ধাক্কার পেছনে মুসলিম-হিন্দু সম্মিলিত একটি প্রচেষ্টা ছিল। এর আগেও ডিভাইড এন্ড রুল এর ব্যাপারটা ছিল, কিন্তু তখন তারা আরো শক্তভাবে এটি গ্রহণ করে। 

তখন তারা কী করল? তারা ধর্মীয় ভিত্তিতে আদমশুমারি করল, কতজন মুসলমান আর কতজন হিন্দু। বাংলাদেশে তারা দেখালো যে, হিন্দুদের চেয়ে মুসলিমদের সংখ্যা আগে কম ছিল, এখন সেই সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। মজার ব্যাপারটা হলো: ১২০৪ থেকে ১৭৫৭ পর্যন্ত গোটা সময়টা মুসলিমরা বাংলা এবং ভারত শাসন করল, কিন্তু শহরাঞ্চল বা শাসন কেন্দ্রের দিকে হিন্দুরা সংখ্যায় বেশি ছিল আর দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলগুলোতে মুসলিমদের সংখ্যা বেশি ছিল। কেন? কারণ দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলগুলোতে সুফি এবং দায়ীরা ব্যাপক কাজ করেছিলেন। তাদের কাজের মধ্যে হৃদয় জয়ের ব্যাপারটা থাকে, জবরদস্তি থাকে না। এভাবে নগর কেন্দ্রের মধ্যে, যেখান থেকে শাসন পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে মুসলমানরা যখন সংখ্যাগুরু নন, তখন প্রমাণিত হয় যে, অমুসলিমদেরকে মুসলিম বানাবার কোনো রাজনৈতিক প্রকল্প মুসলিম শাসকরা গ্রহণ করেননি।

  তৃতীয়ত, ব্রিটিশরা দেখালো যে, এখানকার ভূমি এবং ভাষা- এই দুই জিনিসের আত্মীয়তা মুসলিমদের সাথে নেই। এই কথা নিজেরা বলবার চেয়ে স্থানীয়দের দিয়ে বলাবার চেষ্টা করল। তারা যেহেতু মুসলিম-হিন্দু বিভাজনটাকে বড় করে তুলেছিল, সেহেতু হিন্দুদের ভেতর থেকে নতুন একটি মিডল ক্লাস তৈরি হল। এই মিডল ক্লাসের লোকেরা তাদের থেকে শিক্ষা লাভ করেছে, নতুন আলোকায়নে আলোকিত হয়েছে। ফলে তারা এখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে লিখতে শুরু করল। 

১৭৫৭ সালের আগে কোনো হিন্দু লেখক মুসলমানদেরকে দখলদার হিসেবে, স্থানীয়দের প্রতিপক্ষ হিসেবে কখনো দেখাবার চেষ্টা করেনি, বরং আপনি মনসাবিজয় এবং মনসামঙ্গল কাব্য পড়লে দেখবেন যে, বিপ্রদাস পিপলাই দেখিয়েছেন মুসলমানদের সাথে স্থানীয়দের মিথস্ক্রিয়ার ফলে কীভাবে ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ হচ্ছে, জীবনাচারের ক্রমোন্নতি ঘটছে এবং কীভাবে উন্নত একটি জীবনযাত্রার পরিবেশ চারদিকে তৈরি হয়েছে। মুসলিমদের সম্পর্কে তিনি বলছেন যে, “বড়ই দানিশমন্দ, না জানে কপট ছন্দ।” অর্থাৎ, মুসলিমরা সাধারণত দানিশমন্দ হয়ে থাকেন, যাদেরকে আমরা পন্ডিত-বিবেকবান-বুদ্ধিমান বলে থাকি এবং তারা কোনো প্রতারণা কিংবা অপকৌশলের আশ্রয় নেন না। 

আপনি আরো দেখবেন যে, মুসলিমরা যখন এসেছেন প্রথম দিকে, সেই সময়ের একটি লেখা আমরা পাই যার নাম হলো ‘নিরঞ্জনের রুশমা।’ রুশমা কথার অর্থ ক্রোধ। এই কাব্যগ্রন্থে কালিমা জালাল নামে তার যে কাব্য, সেখানে তিনি লিখেছেন মুসলমানরা কীভাবে আসলেন, কীভাবে বাংলায় জাজপুরে তারা প্রবেশ করলেন। প্রবেশের বিবরণ যখন তিনি দিচ্ছেন তখন বলছেন যে, “যথেক দেবতাগণ সবে হইয়া এক মন, প্রবেশ করিলা জাজপুরে।” অর্থাৎ, মুসলমানদের প্রবেশটাকে তিনি বলছেন দেবতাদের প্রবেশ। তিনি আরও দেখাচ্ছেন যে, বৈদিক ব্রাহ্মণদের ১৬০০ পরিবার সেখানে ছিল, তাদের অত্যাচারে উৎপীড়িত সাধারণ মানুষ কত বেশি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে ছিল এবং সেখান থেকে মুক্তি লাভের জন্য ঈশ্বরের কাছে তারা অনবরত কীভাবে প্রার্থনা করছিল। মুসলিমদের আগমনটাকে তিনি দেখিয়েছেন ঐ জুলুমের বিরুদ্ধে ঈশ্বরের ক্রোধের প্রতীক হিসেবে; অর্থাৎ, ঈশ্বর মুসলমানদেরকে উদ্ধারকর্তা হিসেবে এখানে প্রেরণ করেছেন, অত্যাচারী ব্রাহ্মণদের ধ্বংসকারী হিসেবে। 

হলায়ুধ মিশ্রের একটি কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে ‘সেখশুভোদয়া।’ তিনি ছিলেন মুসলিমদের হাতে যে লক্ষ্মণ সেনের পতন হয়েছে, সেই লক্ষণ সেনের সভাকবিদের একজন। তিনি ‘সেখশুভোদয়া’-এর মধ্যে শেখ বা মুসলমানের মাহাত্ম্য বর্ণনা করছেন, সুফির মাহাত্ম্য বর্ণনা করছেন। এরূপ কখন ঘটে? যখন মুসলমানেরা এখানে উদ্ধারকর্তা হিসেবে, জনগণের কামনা-বাসনার সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে এখানে আসেন। নতুবা ব্যাপারটা উল্টো হতো যে, বহিরাগতরা এসেছে, তাই স্বদেশকে উদ্ধার করতে হবে, মুক্ত করতে হবে- এরকম আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হতো। কিন্তু ১২০৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে নিয়ে সমসাময়িক কোনো সাহিত্যের মধ্যে এমন কিছু আমরা পাই না যে, বাংলা কোনো বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে, বরং উত্তরণের আনন্দ এবং উল্লাস তৎকালীন সাহিত্যের মধ্যে আমরা পাচ্ছি।

  বাংলায় মুসলমানদের আগমন নিয়ে তিব্বতীয় একজন ধর্মগুরু এবং ইতিহাসবিদ কুলাচার্য জ্ঞানানশ্রী তার ‘ভদ্রকল্পদ্রুম’ গ্রন্থের মধ্যে লিখেছেন: বখতিয়ার খিলজী যখন মির্জাপুরে ছিলেন, তখন সেই মির্জাপুরের ঘাটিতে বাংলার বৌদ্ধদের পক্ষ থেকে একদল প্রতিনিধি গিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করে বললেন যে, আমরা এখানে নিপীড়িত অবস্থায় আছি। আমাদেরকে উদ্ধার করবার জন্য আপনি এখানে আসেন। এটি কোনো মুসলিমের বিবরণী না, কুলাচার্য জ্ঞানানশ্রী এটি লিখেছেন এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ইতিহাসের অধ্যাপক তিনিও এই সত্য কবুল করেছেন যে, বখতিয়ার যখন আসেন, তখন স্থানীয়দের পক্ষ থেকে কিছু বৌদ্ধরা গুপ্তচরের কাজ করেছিল,পথের দিশারীর কাজ করেছিল।

  বখতিয়ার খিলজীর জন্ম আফগানিস্তানের গরমশির নামক জায়গার দাস্তি মার্গ এলাকায়। ফলে বখতিয়ার খিলজী এসে বাংলা জয় করেছেন- এটি বহিরাগত ঘটনা ছিল না। কারণ আর্যাবর্তের মহাভারতীয় সীমানার ভেতরে আফগানিস্তানও ছিল। ফলে খোদ হিন্দুত্ববাদী ন্যারেটিভ অনুযায়ী বখতিয়ার বহিরাগত ছিলেন না, আর্যাবর্তের একজন বাসিন্দা ছিলেন। 

তারপর তিনি সেখান থেকে গজনী গেলেন, সেখানে তিনি মুহাম্মাদ ঘুরির সেনাবাহিনীতে চাকরি চেয়েছিলেন, চাকরি না হওয়ায় তিনি দিল্লিতে আসলেন কুতুবুদ্দিন আইবেকের সেনাবাহিনীতে চাকরি লাভের জন্য। সেখানেও তার চাকরি হলো না। দিল্লি থেকে তিনি গেলেন বাদাউন, সেখানে মালেক হিজবুর উদ্দিনের সেনাবাহিনীতে চাকরি লাভ করলেন। হিজবুর উদ্দিন তাকে ছোট একটি চাকরি দিয়েছিলেন, ঐ চাকরির ওপর তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। সেখান থেকে তিনি অযোধ্যায় গিয়ে সীমান্তবর্তী দুটি পরগনার জমিদার হলেন অযোধ্যার রাজার তরফ থেকে। সেই জায়গায় বাইরের লোকেরা আক্রমণ করত। আক্রমণ প্রতিরোধ করবার জন্য একজন যোদ্ধা দরকার ছিল, তাই বখতিয়ারকে সেখানে দায়িত্ব দেওয়া হলো। তিনি ঐ পরগনা রক্ষা করতে গিয়ে স্থানীয় বিহারিদের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়লেন। যদিও বাংলায় পাল রাজত্ব উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল সেনদের দ্বারা, কিন্তু বিহারে তখনও পাল রাজত্ব রয়ে গিয়েছিল। তাদের সাথে সংঘাতের এক পর্যায়ে তিনি বিহারে প্রবেশ করলেন, বিহার থেকে ঝাড়খন্ডের জঙ্গল হয়ে তিনি বাংলায় এসেছেন। 

যখন তিনি বাংলায় আসলেন, তখন তার সাথে একটি সেনাবাহিনী ছিল, কিন্তু তিনি এত দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছিলেন যে, পেছনের সেনাবাহিনী তার গতির সাথে সঙ্গতি রক্ষা করতে পারছিল না। যখন তিনি জঙ্গল পার হলেন এবং দেখলেন যে, নিজের সাথে মাত্র ১৭-১৮ জন সৈন্য, তখন তো তার থেমে যাওয়ার কথা যে, বাকি সেনাবাহিনী আসুক। কিন্তু সামরিক সক্ষমতা, কৌশল, বুদ্ধিমত্তা এবং জয় করবার এত স্পৃহা তাদের মধ্যে ছিল যে, তারা নিজেরাই রাজধানীতে প্রবেশ করলেন! কীভাবে প্রবেশ করলেন? তারা জানতেন যে, সেদিন একদল ঘোড়া ব্যবসায়ী আসবে, সরকারের তরফ থেকে প্রহরীদেরকে বলে দেয়া হয়েছে যে, সেই ব্যবসায়ীদের যেন প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। তিনি রাজধানীতে প্রবেশের আগেই তার গোয়েন্দারা রাজধানীতে ছিল, তাই এমন অত্যন্ত গোপনীয় রাজকীয় আদেশ সম্পর্কে বখতিয়ার জানতেন। অতঃপর তিনি ঘোড়া ব্যবসায়ী হিসেবে শহরে প্রবেশ করলেন। 

যখন তিনি বালাখানার কাছে গেলেন, লক্ষণ সেন তখন খেতে বসেছে। বখতিয়ার সেখানে প্রবেশ করে তাকবীর দিলেন, তখন লক্ষণ সেন কোনো পদত্যাগপত্র জমা না দিয়ে পালিয়ে গেলেন। তারপরে বাকি সেনাবাহিনী শহরে এসেছে। আচ্ছা, যদি বাইরে থেকে কেউ এসে ঢাকা শহর জয় করে ফেলে এবং আপনারা সবাই তখন ঘুমে ছিলেন, সকালে যেইমাত্র শুনলেন, আপনারা কি ঘুমের মেয়াদ আরো লম্বা করবেন? না, সেই পরিস্থিতিতে আর ঘুমানো যায় না। আপনারা জেগে উঠবেন এবং প্রতিবাদ করবেন। বখতিয়ার খিলজী যখন বাংলা জয় করলেন, তখন একটি প্রতিবাদের আওয়াজও শহরের কোনো প্রান্ত থেকে উচ্চারিত হলো না, কারণ শহরবাসী আগে থেকেই এই কাফেলাকে বরণ করে নেবার জন্য প্রস্তুত ছিল, যা আমরা আগে আলোচনা করেছি। এটিকে কোনোভাবেই উপনিবেশ বলে না।

  অনেকে বলবেন যে, এইরকম ঘটনা ১৭৫৭ সালেও ঘটেছে, কারণ লর্ড ক্লাইভ ব্রিটিশ আদালতে বলেছে: আমরা যখন রাজধানীতে প্রবেশ করলাম, তখন চারপাশে দাঁড়ানো জনগণ আমাদের দিকে যদি ঢিলও ছুঁড়তো, তাহলে আমরা সেখানেই মারা যেতাম। জনগণ ঢিল ছুড়ে নাই ফলে আমরা প্রবেশ করেছি। কিন্তু উভয় ঘটনার মধ্যে পার্থক্য আছে। লর্ড ক্লাইভ যখন রাজধানী মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করে, তখন সে শাসক হয়ে প্রবেশ করেনি। জনগণ দেখেছে তার সামনে মীর জাফর, ঘষেটি বেগম; অর্থাৎ, নবাব পরিবার। ফলে জনগণ এটি আঁচ করতে পারেনি যে, পুরনো শাসন ধ্বংস হয়ে গেছে এবং নতুন কেউ শাসনভার দখল করেছে। এখানে বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপার ছিল। মীর কাসেম আলী খোদ পলাশীর বিশ্বাসঘাতকদের একজন হয়েও যেইমাত্র বুঝে গেলেন যে, ব্রিটিশরা ক্ষমতা দখল করবার চেষ্টা করছে, সেই মুহূর্তেই তিনি বিদ্রোহের পতাকা উড়িয়ে দিলেন, বক্সারের যুদ্ধ হলো, তিনি জীবন দিয়ে দিলেন। বখতিয়ার খিলজীর সময় এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

  ব্রিটিশরা আমাদেরকে শাসন করেছে এখানে আর লুটপাট করে সম্পদ পাচার করা হয়েছে লন্ডনে। উপনিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো: শাসন করবে এক জায়গায় আর পাচার করবে আরেক জায়গায়। যখন ব্রিটিশরা এখানে আসে, তখন গোটা পৃথিবীর মোট সম্পদের ২৫ শতাংশ ছিল ভারত উপমহাদেশে আর ভারত উপমহাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল বাংলা। ১৭৫৭-১৭৭৯ এই সময়ে তারা এত লুটপাট করল যে, এরপরে একটি মহা দুর্ভিক্ষ হলো। দুর্ভিক্ষের কারণে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ অনাহারে মারা গেল। এই সীমাহীন লুটপাট করে তারা ব্রিটেনে পাঠিয়েছে।

 মুসলমানেরা এখানে এসেছেন, শাসন করেছেন, কিন্তু এই ভূমি লুটপাট করে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেবার জন্য তাদের কোনো পশ্চাৎভূমি কোথাও ছিল না। তারা এখানে এসেছেন, এই ভূমিকেই তাদের ভূমি হিসেবে গ্রহণ করেছেন, এখানেই উন্নয়ন ঘটিয়েছেন, এখানেই সমৃদ্ধি এনেছেন, এখানকার ভাষার উন্নয়ন ঘটিয়েছেন,জীবনমানের উন্নয়ন ঘটিয়েছেন, এখানকার মানুষেরাই ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছ। প্রমথ চৌধুরীর মতে, বাংলা সাহিত্য মুসলমানদের দান। দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, মুসলমানরা যদি না আসতেন, তাহলে বাংলা সাহিত্যের জন্ম হতো না। ‘প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান’ শিরোনামে দীনেশচন্দ্র সেন আলাদা একটি গ্রন্থ-ই রচনা করেছেন। তার ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থেও তিনি এগুলো আলোচনা করেছেন।

  আমাদের গ্রামীণজীবন, নগরব্যবস্থা, খাদ্যরুচি, পঞ্চায়েত- সমস্ত কিছুকে আজ আমরা যে আকারে দেখছি,  তার পেছনে মুসলিম শাসনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এই যে এতো বাঙালিত্বের কথা বলা হয়, শুরুর দিকে বঙ্গ কথাটা ছিল, কিন্তু বাঙ্গালী কথাটাই ছিল না। মুসলমানেরা বাঙ্গালী পরিচয়টাকে অত্যন্ত মহিমার সাথে ধারণ করলেন। বাংলার মুসলমানদের ইতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে মহান সুফীদের একজন হলেন আঁখি সিরাজউদ্দিন, তিনি নিজের নামের মধ্যে লাগাতেন বাঙ্গালী। আঁখি সিরাজউদ্দিনের জামাতা ছিলেন আলাউল হক, তিনি বাংলার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ আলেমদের মধ্যে অন্যতম; তিনি নিজের নামের সাথে লাগাতেন বাঙ্গালী। আলাউল হকের পুত্র নূর কুতুবুল আলম নিজের নামের সাথে লাগাতেন বাঙ্গালী।

আমরা আধুনিক কালেও দেখেছি, গাজী ইমাম উদ্দিন (মৃত্যু: ১৮৫৯), তাঁর নামের শেষে ছিল বাঙ্গালী; আব্দুল ওয়াহিদ(মৃত্যু:১৯০৫), তাঁর নামের শেষেও বাঙ্গালী। আমাদের সুফিদের, ওলামাদের মধ্যে আমরা এটি পাই যে, অমুক দিমাশকী, অমুক ইয়ামানি, অমুক সানআনী ইত্যাদি। এটিকে বলে মানে মানসুব করা; অর্থাৎ,  কোনো কিছুর সাথে নিজেকে সম্বন্ধিত করা। এমনকি সাহাবাদের মধ্যেও আশআরী, গিফারী, ফারসী, হাবশী ইত্যাদি মানসুব করার প্রচলন ছিল। ইসলামের কাছে এটি একটি মহিমান্বিত অনুশীলন। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে জানিয়েছেন যে, তিনি আমাদের বিভিন্ন গোত্র ও বংশে আলাদা করেছেন। কেন? যাতে আমরা পরস্পর পরস্পরকে চিনতে পারি। অর্থাৎ, নিজের ভূমির পরিচয়টাকে বহন করা আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রায়ের সাথে যুক্ত। 

এভাবে যে জায়গায় ইসলাম গিয়েছে, সেখানকার স্থানীয় ভাষার সাথে, ভূমি ও ভূমির ঐতিহ্যের সাথে ইসলাম কোথাও সংঘর্ষে লিপ্ত হয়নি, এ কথা হিন্দুরাও স্বীকার করেছেন। স্বামী বিবেকানন্দ তার প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য গ্রন্থে এরূপ বলেছেন যে, মুসলিমরা যেখানেই গিয়েছে, সেখানেই স্থানীয় ভাষার বিকাশ ঘটিয়েছে, স্থানীয় সংস্কৃতির পরিশীলনের মাধ্যমে সর্বত্র এর বিকাশ ঘটিয়েছে। উর্দু ভাষা মুসলিমরা সৃষ্টি করেছেন, পশতু ভাষার বিকাশ ঘটিয়েছেন মুসলমানেরা, সিন্ধি ভাষার বিকাশ ঘটিয়েছেন মুসলমানেরা। এরপরে এই স্থানে অনেকগুলো ভাষার বিকাশ ঘটিয়েছেন। এভাবে বাংলা ভাষারও বিকাশ ঘটিয়েছেন তাঁরা। বাংলা ভাষার স্রষ্টা মুসলমানেরা না, কিন্তু তাঁরা বাংলা ভাষাকে শৈশবে মাতৃদুগ্ধ পান করিয়েছেন।

  এভাবে আমরা দেখলাম যে, হিন্দুত্ববাদী যে ন্যারেটিভ – আর্যরা এই বঙ্গের ভূমিপুত্র আর মুসলিমরা বহিরাগত – এটি সম্পূর্ণ ভুল। বরং আর্যরাই এই ভূমিতে বহিরাগত। অপরদিকে মুসলিমরা হল এই বঙ্গের ভূমিপুত্র। তাঁরা আদি থেকেই বাঙ্গালী পরিচয়কে ধারণ করেছেন, এর বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং বঙ্গভূমির ভাষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা – সবকিছুই মুসলিমদের হাতে লালিত-পালিত হয়েছে।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

The Muslim Minds is a knowledge-based islamic intellectual platform led by young, research oriented muslims under the guidance of experienced scholars. Our mission is to address modern intellectual crises through deep academic analysis and revive Islamic thought as a comprehensive worldview.

Subscribe Now

    Contact Us

    Copyright © 2025 The Muslim Minds. All Rights Reserved