শাহবাগের এন্টি-ইসলামী সেক্যুলার জিনিওলজি- ড. তানজিন দোহা [পরিমার্জিত]
শাহবাগকে অনেক দিক থেকেই বিশ্লেষণ করা যায়। ফ্যাসিবাদ শব্দটিকে টেকনিক্যালি চিন্তা করলে শাহবাগকে বর্ণনা করতে সবসময় ‘ফ্যাসিজম’ শব্দ ব্যবহার করার দরকার নেই, যদিও ড. মাহমুদুর রহমান (সম্পাদক, আমার দেশ) সুনির্দিষ্টভাবে ‘ফ্যাসিজম’ শব্দটা যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তা রাজনৈতিকভাবে বেশ সফল হয়েছে। কিন্তু শাহবাগের চরিত্র এবং ইতিহাসের ব্যাপারে কিছু বর্ণনার জায়গা, কিছু বিশ্লেষণের সুযোগ আছে যেটা আমাদের সকলের জন্য জানা জরুরি এবং এটি আমার গবেষণার সাথেও সম্পর্কিত। প্রশ্ন হলো ‘ওয়ার অন টেরর’ বা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্তযুদ্ধ’ কীভাবে একটা পোস্ট কলোনিয়াল রাষ্ট্র বা সোসাইটি ইনহেরিট করল? কীভাবে ১/১১ এবং তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে ওয়ার অন টেররের একটি সরকার (শেখ হাসিনার সরকার) আমাদের ওপর চেপে বসেছিল?
‘ওয়ার অন টেরর’-কে বা এই সরকারকে বুঝতে হলে আমাদেরকে প্রথমে বুঝতে হবে যে, এটি একটি ওয়ার বা যুদ্ধ। প্রতিটি যুদ্ধেই একটি ক্যাটাগরিক্যাল এনিমি থাকে। সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের ক্যাটাগরিক্যাল এনিমি হলো ইসলামপন্থীরা, অর্থাৎ যারা ইসলামপন্থার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে, যারা সেক্যুলার ডকট্রিন তথা প্রাইভেট ও পাবলিক বিভাজনে বিশ্বাস করে না। “সেক্যুলার প্রস্তাবনা অনুযায়ী রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও বাসনাকে সেক্যুলার ভাষায় উপস্থাপন করতে হবে এবং ধর্মীয় কার্যাবলী সব প্রাইভেট সেক্টরে থাকবে”- এই মনোভাব এবং এখান থেকে আসা রাজনৈতিক ধারণার সাথে ওয়ার অন টেররের একটা সংযোগ খুব পরিস্কার। এটি কিন্তু একটা লিবারেল পলিটিক্যাল ধারণা।
শাহবাগের রাষ্ট্রকল্পে বাঙালিরা হলো জংলি-অসভ্য। শাহবাগ হলো যেসব বাঙালিরা চেয়েছে, কিন্তু ঠিকমতো লিবারেল হতে পারেনি, তাদের চেতনার বহিঃপ্রকাশ। তারা পাকিস্তান-বিরোধী। উল্লেখ্য, এখানে আমি পাকিস্তান বলতে একটা ধারণা, একটা আন্দোলন, একটা ঐতিহাসিক লিগ্যাসির কথা বোঝাচ্ছি। তারা পাকিস্তান-বিরোধিতার জায়গা থেকে মানুষকে রাজাকার হিসেবে শ্রেণিকরণ করেছে। ‘রাজাকার’ ব্যাপারটাও আমাদেরকে খোলাসা করে সুন্দরভাবে বুঝতে হবে। একাত্তরের যে উত্তেজনা ছিল, ইতিহাস ছিল— সেটা না বুঝেই একটা ‘স্টেরিওটাইপ’ তৈরি করে, ‘মব’—এর মত আবহ তৈরি করা হয়েছিল। সেই সময় যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে মিথ্যা ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে যেসব ঘটনা ঘটেছিল, সেটিও তাদের পছন্দ হয়নি; তারা চেয়েছিল সবার সামনে ফাঁসি দিয়ে দেয়া হোক। ‘ওয়ার অন টেরর’ যারা করে, তাদের তথা সেক্যুলারদের কিছু পারিবারিক ঝগড়া (Family quarrels) আছে। কিছু কিছু ভদ্র সেক্যুলার আছে যারা বলে, সাম্য ও মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে সিটিজেন স্টেট করে ফেললেই তো আর শাহবাগ থাকে না। শাহবাগ বলবে যে, না, সব মোল্লাদেরকে আর রাজাকারদেরকে ধরে এনে তোমরা রাস্তার উপরেই জবাই দিয়ে দাও। এগুলো হচ্ছে তাদের পারিবারিক ঝগড়া, অর্থাৎ তারা শত্রুকে কীভাবে মোকাবেলা করবে সে বিষয়ে মতপার্থক্য, যেখানে শত্রু হলো ইসলাম। কেউ কেউ বলবে ইসলামের মিনিং আমি পরিবর্তন করে দেই, কেউ কেউ বলবে ভেতর থেকে ইসলামকে আমি অন্যভাবে বুঝি বা এভাবে নিয়ন্ত্রণ করি। শাহবাগ হলো ওয়ার অন টেররের ডিসকোর্স তথা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ।
ওয়ার অন টেরর কী সেটাও আমাদের বুঝতে হবে। থিওরিতে ডিসকারসিভ (Discursive) নামক একটি শব্দ আছে। আমরা যে বাক্যগুলো উচ্চারণ করি বা যেসকল কনসেপ্ট নিয়ে চিন্তা করি, সেগুলোর একটি ইতিহাস থাকে। একটা শব্দ কীভাবে গঠিত হয়— এগুলো নিয়ে স্টাডি হয়। সাধারণত যারা ফিলোসোফি চর্চা করেন, তারা এই জিনিসগুলো নিয়ে স্টাডি করেন। তারা বুঝতে চান যে, একটা শব্দের অর্থগুলো কী কী? একটা শব্দের অর্থ কিন্তু পরিবর্তিত হতে থাকে। সুতরাং, একটা নির্দিষ্ট ফ্রেইমের মধ্যে সেই শব্দের অর্থগুলো কী কী?- এটা বুঝতে হবে।
‘ওয়ার অন টেরর’ এরও কিছু ডিসকারসিভ ব্যাপার আছে। এখানে ল এন্ড রেগুলেশন (আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন) এর ব্যাপার আছে, প্র্যাক্টিস (কার্যকর করা) এর ব্যাপার আছে, ইনস্টিটিউশনস (প্রতিষ্ঠান) এর ব্যাপার আছে। পলিটিক্যাল ডিসিশন মেকিং, মিলিটারি এবং সিকিউরিটি অ্যাপারেটাস এবং ইন্টেলিজেন্ট কোয়ার্টারের কিছু স্পেসিফিক ডিস্ট্রিবিউশন আছে, এগুলোর কিছু রাজনৈতিক প্রস্তাবনা আছে।
শাহবাগ বাংলাদেশে স্ট্র্যাটেজিক ফাংশনের জন্য ‘ওয়ার অন টেরর’-কে একটা ডক্সা (Doxa) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ডক্সা কি? ডক্সা হলো একটি সাধারণ বিশ্বাস। ফিলোসফিতে এখন অনেকে কথায় কথায় ‘এপিস্টেমোলজি’ শব্দটা ব্যবহার করে। এপিস্টেমোলজি এমন একটা ফিল্ড যেখানে জ্ঞান কীভাবে সৃষ্টি হয়— সেটা নিয়ে আলোচনা করা হয়। কোনো কিছুকে ‘জ্ঞান’ হতে হলে নিশ্চয়তা (Certainty) লাগে, কিছু বোঝাপড়া (Understanding) লাগে। জ্ঞানে পরিণত হবার আগেই ডক্সা আকারে সমাজে কিছু সাধারণ ধারনা থাকে, যেমন: আমরা যে বাঙালি চেতনার কথা বলি সেটিও কিন্তু ডক্সা। এগুলো স্রেফ মতামত বা বিশ্বাস, কোনো ভেরিফাইড বিশ্বাস না। তাই এগুলো হচ্ছে ডক্সা।
বাঙালি সেক্যুলারদের বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থা খুবই করুণ এবং আইকিউ আশঙ্কাজনকভাবে কম। ‘ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ’-য়ের একটি রিপোর্ট বের হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে: যারা কথায় কথায় বাঙালি হিসেবে মিথ্যে অহংকারে ভোগে— এটা একটা হীনম্মন্যতার জায়গা থেকে এসেছে। বাঙালি সেক্যুলারদের আইকিউ হলো ‘লেস দ্যান অ্যাভারেজ’ (৭৪)। পাকিস্তানে এটা ৮০, এটাও মোটামুটি লো, তবু বাঙালিদের চেয়ে বেশি। আফগানিস্তানের আরেকটু বেশি, ৮২। মায়ানমারের কিন্তু ৯১। ভারত আর বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে আইকিউ লেভেলের দিক থেকে। এটা খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। যেহেতু এদের আইকিউ লেভেল খারাপ, সেহেতু ওরা যখন ‘কনসেপ্ট অফ এনিমি’-কে কনসেপচুয়ালাইজ করে, তখন সেটাও ঠিক মত করতে পারেনা। আমরা যখন “ফ্যাসিজম, ফ্যাসিজম” করি— আমাকে সেটা উদ্বিগ্ন করে। ফ্যাসিজমের কিন্তু একটা ইন্টেলেকচুয়াল ক্যাপাসিটি থাকতে হয়, শুধু মিলিটারি ক্যাপাসিটি থাকলেই হয়না। তাই এটা বলা টেকনিক্যালি একটু কঠিন যে, বাঙালির ফ্যাসিজম করার ক্ষমতা আদৌ আছে কিনা!
তবে এটা একটা ‘ওয়ার অন টেরর’—এর সরকার এবং এটা একটা নেক্রোপলিটিক্যাল বা লাশতান্ত্রিক সরকার, যেমনটা ক্যামেরুনিয়ান তাত্ত্বিক অ্যাচিল এমবেম্বে বলেছেন। মৃত্যুকে কীভাবে সমাজে ডিস্ট্রিবিউট করা যায়, কীভাবে ক্লাসিফাই করা যায়, কাদেরকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে এবং কীভাবে তা প্র্যাকটিসের মাধ্যমে হাজির করতে হবে— এসবকিছুর সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়াই হলো লাশতন্ত্র বা নেক্রোপলিটিকস। শুধুমাত্র পলিটিক্যাল পার্টির জায়গা থেকে আমি বলছি না, পলিটিক্যাল গেইমসম্যানশিপের নানা জায়গা থেকে একটা নেক্রোপলিটিক্যাল রেজিম হাজির হতে পারে। তাই শাহবাগের ক্ষেত্রে এটা আমাদের বুঝতে হবে যে, কীভাবে ‘ওয়ার অন টেরর’কে জনগণের মাঝে বৈধতা দান করা হয়েছে। একইসাথে, ওয়ার অন টেরর যেহেতু ইসলামের সাথে সম্পর্কিত এবং এটি যেহেতু ইসলামের বিরুদ্ধেই ওয়ার, সেকারণেই ইসলাম প্রশ্নটা পাবলিক পলিটিক্সে খুবই জরুরি।
ডক্সার ব্যাপারটা আরেকটু সহজ করি। এটি হলো কমন কিছু মতামত বা বিশ্বাস। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়: একাত্তরের চেতনার যেসব ভুলধারণাগুলো সত্য আকারে হাজির হতে চায়, এগুলো ডক্সা। কিছুসময় আগে খবর পাওয়া গেল যে, মুক্তিযুদ্ধের কাউন্সিল নাকি নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞায়িত করবে! সেই সংজ্ঞার মধ্যে আবার বিশাল সমস্যা। সংজ্ঞার মধ্যে ইসলামকে শত্রু হিসেবে রাখা হয়েছে। (মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হিসেবে) জামায়াতে ইসলামীর মতো বিভিন্ন দলের কথা বলা হয়েছে। যেমন: আল-বদর, আল-শামস— সেই পুরনো ধরনের স্টেরিওটাইপ। তবে এসবের আগে শুধু একটি বাক্য যোগ করা হয়েছে যে, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচারের আলোকে আমরা মুক্তিযুদ্ধকে দেখতে চাই এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা এর বিরুদ্ধে ছিল তারা হলো অমুক, অমুক, অমুক। সেসব দলগুলোর মধ্যে সবগুলোই হলো ইসলামী বিভিন্ন দল। সুতরাং, প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, শাহবাগের যে ১.০ ফর্মটা ছিল, অর্থাৎ জংলি ফর্মটা, সেখান থেকে আমরা কি শাহবাগ ২.০— এর দিকে যাচ্ছি কিনা?
কাজেই একটি ডিসিপ্লিনারি রেজিম এই লিবারেলিজম, লিবারেল সিটিজেন স্টেটের ফ্যান্টাসি বিক্রি করে ইসলামের বিরুদ্ধে আরও ব্যাপক এবং কঠোর পলিসি বাস্তবায়ন করছে কিনা অথবা এ ধরণের আলোচনা (discursive utterances) বহাল রাখছে কিনা কিংবা আলোচনা ছাড়াই রাজনৈতিক ঐক্য (non-discursive political mobilization) করছে কিনা— এই ব্যাপারগুলো আমাদের খুবই গুরুত্বের সাথে ভাবা উচিত। এ ব্যাপারটা আমলে না নিলে বাকি সব আলোচনা শুধু বিতর্কমূলক (polemical) আলোচনা হবে। এটা তো আমাদের কনসেপচুয়ালি বুঝতে হবে যে, একটি লিবারেল নাগরিক রাষ্ট্রে শত্রু কে হবে এবং সেই শত্রুকে কীভাবে নির্মাণ করা হবে? চিন্তা করার জন্য এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষেত্র (avenue)। এটা শুধুমাত্র একটি আদর্শিক (ideological) আলোচনা নয়, কিংবা বিতর্কমূলক (polemical) বা বুলিসর্বস্ব (rhetorical) কোনো বিষয় নয়, আবার কেবল রাজনৈতিক আলোচনাও নয়। ব্যাপারটা বিশ্লেষণাত্মকভাবে (analytically) বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, ইসলামকে কীভাবে রেগুলেশন করা হবে, কীভাবে ডিসিপ্লিন করা হবে, কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে—এগুলো খুবই অপরিহার্য প্রশ্ন। এই প্রশ্নগুলো আমাদের জন্য বোঝা জরুরি।
আরেকটি বিষয় হলো: এই নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান সংশোধন নিয়ে কিছু প্রস্তাব চেয়েছিল। সংবিধান সংশোধন প্রস্তাব মানে কী? তারা বলেছে যে, একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজের নানা অংশের সকল মানুষেরা সংবিধান নিয়ে প্রস্তাব দিতে পারবে। তো আমরা, ইসলামপন্থীরাও তো প্রস্তাবনা দিয়েছি, তাইনা? অন্যান্য অনেক ইসলামী দল প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু সংবিধান সংশোধন কমিটির যে বক্তব্য আমরা শুনলাম, তাতে স্পষ্ট হলো যে, ইসলামী ধারা থেকে যেসকল প্রস্তাব টিপিক্যাল পশ্চিমা সাংবিধানিক ডিস্কোর্স (Typical Western Constitutional Discourse) হাজির করে নাই, সেগুলোকে তারা নাকচ করেছে। ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের (দমন-পীড়নমূলক নীতি) বিরুদ্ধে শরিয়া বেঞ্চের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতার যে কথা বলা হয়েছিল, সেই ক্ষমতাকে তারা কোনোভাবেই স্বীকার করতে চায়নি। তারা শুধু চায় ইসলামপন্থীরা এসে সেক্যুলারদের পা সালাম করে, ক্ষমা চেয়ে রাজনীতি করবে এবং তাদের (সেক্যুলারদের) সবকিছুই মেনে নেবে। ইসলামপন্থীরা শুধুই নাগরিক হিসেবে থাকবে, তাদের কোনো ইসলামী স্পিরিট থাকবে না। তাদের (সেক্যুলারদের) কাছে এটা মূলত একটি সমস্যা এবং সেটা তারা নানাভাবে মোকাবেলা করবে।
আমি নেতিবাচক কিছু বলছি না, কিন্তু এটা তো আমাদের আলোচনার মাধ্যমেই খোলাখুলিভাবে বলতে পারা উচিত এবং বলা উচিত। আরেকটি বিষয় হলো: এই সাংবিধানিক আলোচনার মাধ্যমে একটা বিষয় প্রমাণিত হচ্ছে। যদিও আমরা অবশ্যই খুশি যে হাসিনা সরকার নেই— একটি নতুন সমাজের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এবং এই আলোচনায় আমাদের সবার থাকা উচিত, কিন্তু বর্তমানের অন্তর্বর্তীকালীন পরিস্থিতির এই সময়টাতে আমাদের সবারই কিছু কাজ করা উচিত এবং ইসলামপন্থীদের কথাটা গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত। শুধু সারাক্ষণ কীভাবে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, কীভাবে তাদেরকে জোর করে লিবারেল সিটিজেনশিপ বিক্রি করা হবে, এটা সেটা বোঝাতে হবে—এই পলিসি না নিয়ে সত্যিই নতুন চিন্তা এবং নতুন ধরনের রাজনীতি কেমন হতে পারে সেটা ভাবা উচিত। একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যেখানে মুসলিম, সেখানে তাদের স্পিরিটকে মূল্যায়ন করা উচিৎ। তারা যে রাষ্ট্র চায়, সেখানে তো তারা অন্যদেরকে দমন করে রাখবে না। তাদের চাওয়া রাষ্ট্রের ধারণাগুলো কী কী— এটা নিয়ে কোনো সৃজনশীল উদ্যোগ আমরা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকে পাচ্ছি না, যা দুর্ভাগ্যজনক।
আমরা চাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এটা নিয়ে আরো খোলামেলা হোক এবং আমাদেরকে (ইসলামপন্থীদেরকে) স্পেস দেওয়া হোক, যাতে এই আলোচনাগুলো করতে পারা যায়। লিবারেলিজমকে অনুকরণ করে লিবারেল স্টেট, বুর্জোয়া স্টেটের যে ধারণা, যে ধারণায় সবাই সিটিজেন আকারে থাকবে, এটা সত্যিই পুরোনো একটি ধারণা। আরেকটি ব্যাপার হলো: লিবারেল স্টেটের কোনো গ্যারান্টি নেই। সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ তো লিবারেল রাষ্ট্ররাই শুরু করেছে। ওয়ার অন টেরর কে শুরু করেছে? রিপাবলিকানরা। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইউরোপীয় দেশগুলো, সেইসব রিপাবলিকান-লিবারেল রাষ্ট্রগুলো যাদের তথাকথিত নাগরিক অধিকার আছে, সংবিধান আছে, তারাই তো ওয়ার অন টেরর শুরু করেছে। তাহলে শাহবাগ যদি ওয়ার অন টেররেরই যুদ্ধ হয় এবং এখন যারা অন্তর্বর্তী সরকারে আছে, যদি শুধু সিটিজেন স্টেট তৈরিই তাদের আগ্রহ হয়, তাদের সংবিধানটা যদি সেক্যুলারই হয় (সেক্যুলারিজম শব্দ ব্যবহার না করে সেক্যুলার হয়)— তাহলে তো হলো না।
যেমন: ৭১ আর ৭২ এর পার্থক্য নিয়ে এখন মহা ফ্যান্টাসি চলছে। বলা হচ্ছে দুটো একদমই আলাদা জিনিস। বলা হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ৭১ এ ছিল, ৭২ এ সেটি কামাল হোসেনরা ভুল করে কিংবা জোর করে সেক্যুলারিজম লিখে পরিবর্তন করে দিয়েছে। না, বিষয়টি তা নয়। সেক্যুলারিজম হলো প্রস্তাবিত নাম, এটির ব্যাখ্যা হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা ইত্যাদি। এসব কিছুর কেবল সারসংক্ষেপ হলো সেক্যুলারিজম। সুতরাং, ৭১ আর ৭২ এর পার্থক্য খুবই সামান্য, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিষয়দুটো ধারণাগতভাবে কাছাকাছি (Coherent)। ৭১ আর ৭২ এর কনসেপচুয়ালি কোনো অসংগতি (Incoherence) নেই। সুতরাং, আমাদেরকে এসব (লিবারেল সিটিজেনশিপ) বিক্রি না করে তাদের উচিত লিবারেল রাষ্ট্র কায়েম করলে ইসলামের বিরূদ্ধে যুদ্ধ কেন হবে না – সেটা আমাদেরকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলা। সেটা অবশ্যই সাংবিধানিকভাবে আমাদেরকে ব্যাখ্যা করতে হবে ।
বাংলাদেশের সংবিধান থেকে তো ইসলামকে উধাও করে দেওয়া হয়েছে। আমরা যদি একটি ইসলাম-বান্ধব রাষ্ট্র চাই এবং সংবিধানের মধ্যে যদি আল্লাহর উপরে পূর্ণ বিশ্বাস না থাকে, তাহলে আমরা কীভাবে বুঝব যে, এই সংবিধান দ্বারা সুনির্দিষ্টভাবে এক ধরনের ওয়ার ইকোনমি (war economy) তৈরি করা হবে না? এটাতে কোনো স্বচ্ছতা নেই। কাজেই এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক লিগ্যাসি, জিনিওলজি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। সুতরাং, আমাদের এই ইউরোসেন্ট্রিক এবং অ্যামেরিকাসেন্ট্রিক সংবিধানের ধারণাগুলোকে অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে এবং এই আলোচনাগুলোকে প্রকাশ্যে হাজির করতে হবে।
Leave a comment