Home Islamic History ইসলামী ও সেক্যুলার আইন- ১ম অংশ
Islamic History

ইসলামী ও সেক্যুলার আইন- ১ম অংশ

Share
Share

[পরিমার্জিত]

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।

আমাদের আলোচনার মূল বিষয় হলো শরিয়া আইন এবং বিচার ব্যবস্থা। আমরা এটিকে একটি তুলনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখব।

বর্তমানে সারা বিশ্বে তিন ধরনের আইন প্রচলিত:

১. ব্রিটিশ কমন ল (British Common Law)

এই আইনের উৎস হলো রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ান কর্তৃক প্রণীত ‘জাস্টিনিয়ান কোড’ এবং খ্রিস্টান চার্চ ও পোপদের দ্বারা পরিচালিত ‘ক্যানন ল।’ রোমান আইন ছিল সেক্যুলার আর ক্যানন ল ছিল চার্চকেন্দ্রিক বিচার ব্যবস্থা। এই দুইয়ের সংমিশ্রণে ‘ব্রিটিশ কমন ল’ তৈরি হয়েছে। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা যেসব জায়গায় উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, সেসব জায়গা  স্বাধীন রাষ্ট্র হবার পর এই ‘ব্রিটিশ কমন ল’ কে-ই তাদের মূল আইন হিসেবে গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত।

‘ব্রিটিশ কমন ল’ তে ইসলামী প্রভাব:

প্রখ্যাত আরব খ্রিস্টান আইনবিদ জন মাকদিসি তার গবেষণায় তুলে ধরেছেন যে, ব্রিটিশ কমন ল- এর উপর ইসলামের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, উত্তর আফ্রিকা, স্পেন, তিউনিসিয়া, ও মরক্কোতে মালিকি মাযহাবের ইসলামিক আইন প্রচলিত ছিল। মুসলমানরা যখন ইতালির দক্ষিণে সিসিলিতে সাম্রাজ্য স্থাপন করেন, সেখানে আদালত, বিচার ব্যবস্থা, আইন ব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে এই আইন প্রয়োগ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে নরম্যান জাতিগোষ্ঠী সিসিলি দখল করে এবং যেহেতু একই সময়ে নরম্যানরা ইংল্যান্ডও শাসন করছিল, তাই সিসিলির ইসলামিক আইনের প্রভাব তাদের মাধ্যমে ব্রিটেনেও ছড়িয়ে পড়ে। জন মাকদিসির মতে, ব্রিটিশ কমন ল-এর মধ্যে মুসলমানদের শরিয়া বিচার ব্যবস্থা, আদালত এবং আইনের উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্রভাব রয়েছে।

২. কন্টিনেন্টাল ল বা সিভিল ল (Continental Law or Civil Law)

এই আইনের উৎস হলো রোমান আইন এবং ইউরোপের বিভিন্ন সেক্যুলার দার্শনিকদের আইনি ও দার্শনিক আলোচনা। আমেরিকা এবং ইউরোপের কিছু দেশ এই আইন দ্বারা পরিচালিত হয়।

৩. শরিয়া আইন (Sharia Law)

কিছু রাষ্ট্রে শরিয়া আইন সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়, যেমন: আফগানিস্তান, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশ এবং নাইজেরিয়ার কিছু প্রদেশ। এছাড়াও মুসলিম দেশগুলোতে পারিবারিক আইনে শরিয়া আইনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিপূর্ণ শরিয়া আইন চালু আছে বলা ঠিক হবে না, তবে এর প্রভাব রয়েছে।

শরিয়া আইন নিয়ে আলোচনার বিষয়বস্তুকে মূলত তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়:

১. আইন দর্শন (Legal Philosophy): শরিয়া আদালতের বিচার ব্যবস্থা এবং শাস্তির পেছনে একটি সুনির্দিষ্ট দর্শন রয়েছে। একটি ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র যেহেতু শরিয়া আইনের উপর নির্ভরশীল, তাই এর পেছনে একটি সুস্পষ্ট দর্শন থাকা আবশ্যক। কোন কাজকে আমরা অপরাধ বলব, আর কোনটিকে বলব না, কী ধরনের শাস্তি দেওয়া হবে আর কী ধরনের শাস্তি দেওয়া হবে না– এই সমস্ত বিষয় আইনের দর্শনের আওতায় আসে, যা নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব।

২. দণ্ডবিধি (Penal Code): ইসলামিক শরিয়া আইনের দণ্ডবিধি হলো— একটি অপরাধের কী কী দণ্ড বা শাস্তি দেওয়া হয়?

৩. বিচার প্রক্রিয়া (Judicial Process): একজনকে দণ্ড দেওয়ার আগে একটি মামলা দায়ের করা থেকে শুরু করে আদালতে কী কী ঘটে, বিচারক কী কী বিষয় বিবেচনা করেন, কোন সাক্ষ্য বৈধ বা অবৈধ– এই সমস্ত বিচারিক পদ্ধতি বা জুডিশিয়াল প্রসিডিউর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

প্রথমেই আসে দণ্ডবিধির কথা। পশ্চিমা আইনের অনুসারীদের ইসলামী দণ্ডবিধি নিয়ে আপত্তির শেষ নেই। তাদের মতে, এটি অমানবিক, নৃশংস, বর্বর, পাশবিক এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী। উদাহরণস্বরূপ, “চোখের বদলে চোখ, কানের বদলে কান।” ধরা যাক, একজন ব্যক্তি কারো একটি চোখ ইচ্ছাকৃতভাবে নষ্ট করল বা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলে ফেলল। এরপর যথার্থ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যদি সেই লোকটি দোষী সাব্যস্ত হয় এবং যদি বলা হয় অপরাধীরও একটি চোখ তুলে ফেলতে হবে— এই মুহূর্তে তারা (পশ্চিমারা) সবাই অপরাধীর পক্ষে। অপরাধীর অপরাধ সাব্যস্ত হয়ে যাওয়ার পরেও কেন আমি অপরাধীর পক্ষে থাকব? কেন আমি বরাবর বা সমান-সমান বিষয়টিকে সমর্থন করতে পারছিনা? কেন অপরাধীর জন্য আমার দরদ উথলে পড়ছে? এমনকি তারা এখন মৃত্যুদণ্ডেরও বিরুদ্ধে। যদি একজন মানুষ আরেকজনকে খুন করে বা সিরিয়াল কিলিং করে, অর্থাৎ ৮/৯/১০ টা খুন করে, তাকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবেনা, এটা নাকি মানবাধিকার লঙ্ঘন! কতটা হাস্যকর পর্যায়ে চলে গেছে তাদের এই তথাকথিত মানবাধিকার, তথাকথিত Inalienable Rights (যেসব অধিকার অস্বীকার করা যায়না)। প্রত্যেক মানুষের (অপরাধীরও) নাকি বাঁচার অধিকার আছে! তাহলে যে মানুষটিকে হত্যা করা হয়েছে তার বাঁচার অধিকার ছিল না? আইন দর্শন অংশে এই আপত্তিগুলো নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব।

 

তবে, প্রথমেই আমরা ইসলামিক দণ্ডবিধি তথা দণ্ডগুলো কী কী— তা নিয়ে আলোচনা করব। কারণ, এই বিষয়ে অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। ইসলামে মোটা দাগে অপরাধকে দুই ভাগে ভাগ করা হয় (প্রথমভাগকে আবার দুইভাগে ভাগ করা যায়):

  • নির্দিষ্ট শাস্তি (Fixed Punishment): কিছু অপরাধের জন্য শাস্তি নির্দিষ্ট থাকে, যা কুরআন বা সুন্নাহর আইন দ্বারা সুনির্ধারিত। এই অপরাধ  প্রমাণিত হলে তা অবশ্যই কার্যকর করতে হয় এবং এখানে কোন ক্ষমা বা পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই।
  • অনির্দিষ্ট শাস্তি (Non-Fixed Punishment): কিছু ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তি নির্দিষ্ট নয়। এখানে বিচারকের নিকট মৃত্যুদণ্ড থেকে শুরু করে তিরস্কার বা ধমক দেওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের শাস্তির সুযোগ থাকে। তিনি মামলার তীব্রতা, অপরাধের গতিপ্রকৃতি, অপরাধীর সার্বিক অবস্থা, অপরাধের সামাজিক প্রভাব, নৃশংসতা — সবকিছু বিচার-বিবেচনা করে নিজের মত একটা ফ্লেক্সিবল সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন।

শাস্তি নির্দিষ্ট

শাস্তি বিচারকের উপর

কিসাস অপরাধ (হাক্কুল ইবাদ)

হদ্দ্দ অপরাধ (হাক্কুল্লাহ)

তা’যির অপরাধ

ব্যক্তি মাফ করতে পারে

শর্ত প্রমাণ হয়ে গেলে মাফ নেই

  • সকল হদ্দ অপরাধগুলোর নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ না হলে
  • কিসাস-হদ্দ ছাড়া বাকি যত জুলুম, নৈতিক স্খলন, অপরাধ আছে
  • হত্যার বদলে হত্যা
  • অঙ্গের বদলে অঙ্গহানি
  • রক্তপণ (দিয়াত)
  • ক্ষমা
  • ব্যভিচার-ধর্ষণ
  • ব্যভিচারের অপবাদ
  • মাদক সেবন
  • চুরি
  • ডাকাতি-রাহাজানি
  • ইসলাম ত্যাগ
  • বৈধ শরয়ী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ

পশ্চিমা বিশ্বে একটি সমালোচনা প্রচলিত— ইসলামের দণ্ডবিধিগুলো ফিক্সড, খুবই অনমনীয়। আজকে আলোচনা শেষে আমরা বুঝতে পারব যে, ইসলামের দণ্ডবিধি অনমনীয় নয়, বরং পশ্চিমা বিচারব্যবস্থাই বেশি অনমনীয়। পশ্চিমা বিচারগুলোর ক্ষেত্রে একটি মামলা একটি নির্দিষ্ট ধারার আওতায় পড়লে সেই ধারাতেই দিতে হবে। ধরা যাক, ৩০২ ধারায় ফাঁসি হবে। ৩০২ ধারায় যদি কোনো মামলা প্রমাণিত হয়, তাহলে সেই শাস্তিটাই দিতে হবে, অন্য কোন শাস্তি দেওয়া যাবে না। কিন্তু ইসলামে বিচারকের হাতে অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপক ফ্লেক্সিবলিটি দেওয়া আছে, কোনো কিছু ঠিক করে দেওয়া নেই। এখানে বিচারক চাইলে জনকল্যাণ, জননিরাপত্তা বা আসামির অবস্থাকে সামনে রেখে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বিচার করতে পারবেন; এটাকে বলা হয় তা’যির। এক্ষেত্রে শাস্তি অনির্দিষ্ট। 

তা’যির এর আওতায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধ আসতে পারে। যেমন: সুদ, ঘুষ, আমানতের খেয়ানত, অপবাদ দেওয়া, সাহাবীদেরকে গালি দেওয়া, মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া, ঋণখেলাপি, সমকামিতা ইত্যাদি। উল্লেখ্য, হানাফী মাযহাবে সমকামিতা তা’যিরের মধ্যে পড়বে, অন্যান্য মাযহাব অনুসারে এটি হদ্দ্দের আওতায় পড়বে। বিভিন্ন ধরনের অপরাধ, যা-কিছুকে আমাদের শরিয়া, আমাদের উলামায়ে কেরাম অপরাধ বলে মনে করেন, যা সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে বা কারো উপরে জুলুম করে— সবকিছু এই তা’যিরের মধ্যে পড়বে। বিচারকের হাতে মৃত্যুদণ্ড থেকে শুরু করে সতর্কীকরণ পর্যন্ত বিভিন্ন অপশন আছে। যেমন: অপমান করা, অর্থদণ্ড দেওয়া, বরখাস্ত করা, দেশান্তর করা, কারাদণ্ড দেওয়া, বেত্রাঘাত করা ইত্যাদি। বিচারক অবস্থা বুঝে এর যেকোনোটা দিতে পারবেন।

তা’যির অপরাধ

বিচারকের হাতে অপশন

সুদ

মৃত্যুদণ্ড


বেত্রাঘাত (অনধিক ১০০)


কারাদণ্ড


দেশান্তর


বরখাস্ত


অর্থদণ্ড


অপমান (বাজারে ঘোরানো)


সতর্কীকরণ

ঘুষ

আমানতের খিয়ানত

সমকাম (হানাফি)

হদ্দের শর্ত পূরণ হয়নি এমন হদ্দ অপরাধ

অন্যান্য অপবাদ

সাহাবিদের গালি

মিথ্যা সাক্ষ্য

ঋণখেলাপি

যে অপরাধগুলোর শাস্তি নির্দিষ্ট, সেগুলো আবার দুই প্রকার। এক ধরনের অপরাধ হচ্ছে কিসাস। কিসাস কী? এটা হলো বান্দার হক। যেমন: আমি কাউকে মেরে ফেললাম, এটা কিসাসের আওতায় পড়বে। এছাড়াও কারো আঙ্গুল কেটে ফেলা, জিহ্বা কেটে নেওয়া, এমনভাবে মারা যে তার মেরুদণ্ড নষ্ট হয়ে যৌন ক্ষমতা শেষ হয়ে গেল, কান ফেটে গেল বা কান দিয়ে রক্তপাত হলো, পা চিরকালের মত অকেজো হয়ে গেল। এগুলো কিন্তু আমাদের সমাজে প্রায়শই হয়। যেমন: রাজনৈতিক মারামারি। এগুলো বান্দার হক, ব্যক্তি চাইলে এটাকে মাফ করতে পারে। শাস্তি যদিও নির্দিষ্ট, কিন্তু ব্যক্তি যদি চায়, যেমন: নিহতের যারা ওয়ারিশ আছে, তারা যদি চায় মাফ করতে পারে বা যে ব্যক্তির চোখ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, সে যদি চায় তাহলে অপরাধীকে মাফ করতে পারে। এর আওতায় কী কী শাস্তি আছে? এখানে আছে হত্যার বদলে হত্যা, অঙ্গের বদলে অঙ্গহানি। ভুক্তভোগীর যে অঙ্গটা নষ্ট করা হয়েছে, অপরাধীর সেই অঙ্গটা নষ্ট করে দেওয়া হবে। যেমন: চোখের বদলে চোখ, কানের বদলে কান। কেউ যদি বদলা না নিতে চায়, তাহলে অপরাধীর কাছ থেকে টাকা বা অর্থদণ্ডও নিতে পারে।

এখানে একটা ব্যাপার আছে। সেকুলার আইনে যে জরিমানা হয় সেটি কিন্তু বাদী পায় না। অর্থাৎ, যে মামলা দায়ের করছে তথা ক্ষতিগ্রস্ত বা মজলুম, সে জরিমানার অর্থ পায় না। এটি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে চলে যায়। কিন্তু ইসলামে এমনটি নেই। ধরা যাক, কেউ আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে। এখন আমি, আমার বাবা, আমার ভাইয়ের সন্তানরা — আমরা সবাই মিলে ঠিক করলাম — হত্যাকারীকে আমরা মারতে চাই না। আমরা তার কাছ থেকে রক্তপণ (Blood Money) নিতে চাই। আমরা চাইলে এটা করতে পারবো। এতে অপরাধীর জীবনটা বেঁচে গেল। আবার আমি যদি চাই যে, না, তাকে পুরোপুরি ক্ষমা করে দেবো, তার কাছ থেকে টাকাও নিব না— সেটি করারও সুযোগ আছে। এটা হলো কিসাস অপরাধ; যদিও শাস্তি নির্দিষ্ট, অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা কুরআনে যা বলেছেন তাই, কিন্তু এখানে মজলুমকে অথোরিটি দেওয়া হয়েছে। সে চাইলে হত্যার বদলে হত্যা, জখমের বদলে জখম করতে পারবে; আবার সে চাইলে অর্থদণ্ড নিতে পারবে কিংবা ক্ষমাও করে দিতে পারবে- এই তিনটি অপশন তার হাতে আছে।

নির্দিষ্ট শাস্তির মধ্যে আরেক ধরনের অপরাধ রয়েছে, যেটাকে হদ্দ বলা হয়। এটা আল্লাহর হক, এটা কেউ মাফ করতে পারবে না। একবার যদি প্রমাণ হয়ে যায়, এটা মাফ করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিরও নেই, খলিফারও নেই। ভুক্তভোগীরও মাফ করার সুযোগ নেই। এটা সম্পূর্ণই আল্লাহর হক। যেমন: ব্যভিচার, ধর্ষণ, ব্যভিচারের অপবাদ ইত্যাদি। কোন সতীসাধ্বী নারীকে বা কোন সৎ মানুষকে যদি ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়া হয়, সেটাও খুব গুরুতর ইস্যু। এক্ষেত্রেও অন্য কারো মাফ করার সুযোগ নেই। এছাড়াও রয়েছে মাদক সেবন (মদ থেকে শুরু করে যেকোন ধরনের মাদক)। এটি যদি প্রমাণিত হয়, এটিও আল্লাহর হক, কারো মাফ করার সুযোগ নেই। এর বাইরে রয়েছে চুরি, ডাকাতি বা রাহাজানি। চুরি করলে চোরের হাত কেটে দিতে হবে। ডাকাতি বা রাহাজানি হলো ক্ষতি করার ভয় দেখিয়ে, অস্ত্রের মুখে কারো কাছ থেকে সম্পদ নিয়ে নেওয়া। আর চুরি হচ্ছে গোপনে নিয়ে নেওয়া। আরও রয়েছে ইসলাম ত্যাগ বা মুরতাদ হওয়া। এটিও আল্লাহর হক তথা হদ্দ। এগুলোতে কারো কোনো গবেষণার সুযোগ নেই। তা’যির অপরাধে যেমন বিচারকের গবেষণার সুযোগ আছে, হদ্দ অপরাধে কিন্তু এরকমটি নেই। এগুলো ছাড়াও শরয়ীভাবে বৈধ শাসকের বিরুদ্ধে যদি কেউ বিদ্রোহ করে, তাহলে বিদ্রোহীর কী কী শাস্তি দেওয়া হবে— এটিও হদ্দ। 

অতএব বোঝা গেল যে, অপরাধ তিন ধরনের। একটি হলো কিসাস অপরাধ, যার নির্দিষ্ট শাস্তি আছে, কিন্তু ব্যক্তি চাইলে ক্ষমা করতে পারে। আরেকটি হদ্দ অপরাধ, যারও নির্দিষ্ট শাস্তি আছে, কিন্তু ব্যক্তি চাইলেও ক্ষমা করতে পারে না। আরেকটি হলো তা’যির অপরাধ যাতে নির্দিষ্ট শাস্তি নেই, বরং শাস্তির ভার বিচারকের উপর ন্যস্ত, তিনি সার্বিক পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবেন।

অপরাধগুলো প্রমাণ হওয়ার কিছু শর্ত আছে। যদি শর্ত পূরণ না হয় বা যথেষ্ট পরিমাণ সাক্ষী না থাকে অথবা যদি বিন্দুমাত্র কোন সন্দেহের উদ্রেক হয়, কিন্তু বিচারক বুঝতে পারছেন যে, আসলেই সেই ব্যক্তি অপরাধী,  সেক্ষেত্রে বিচারক নির্দিষ্ট শাস্তি না দিয়ে তা’যির শাস্তি দিতে পারবে। অর্থাৎ, কিসাস এবং হদ্দ প্রমাণিত হওয়ার জন্য যে পরিমাণ শর্ত পূরণ হওয়ার প্রয়োজন, সেই পরিমাণ শর্ত পূরণ হয়নি, কিন্তু যে পরিমাণ প্রমাণ আছে তাতে বোঝা যাচ্ছে যে, লোকটি আসলেই অপরাধী, সেক্ষেত্রে বিচারক পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী তা’যির শাস্তি দিতে পারবেন। তখন হদ্দ বা কিসাসের নির্দিষ্ট শাস্তিগুলো আর প্রয়োগ হবে না, বিকল্প শাস্তি হবে। আর হদ্দ-কিসাসের অপরাধগুলো ছাড়া বাকি যত ধরনের জুলুম বা নৈতিক স্খলন আছে— সবকিছুর ক্ষেত্রে বিচারক তা’যির শাস্তি দিতে পারেন।

হদ্দ অপরাধ

ফিক্সড শাস্তি

শর্ত

রহিত হবে

ব্যভিচার-ধর্ষণ

অবিবাহিত

১০০ বেত্রাঘাত

  • চারটি আলাদা মজলিসে অটল স্বীকারোক্তি (বাধা দেবার পরও);
  • চারজন সাক্ষী যারা সুরমাদানি অবস্থায় দেখেছে;
  • একজন কম হলে বাকি তিন জনের উপর অপবাদের সাজা আসবে। 
  • দণ্ডের মাঝখানেও স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করলে;
  • সাক্ষী  একজনও কম হলে;
  • একজনেরও সাক্ষ্যে পার্থক্য দেখা দিলে;
  • ন্যূনতম সন্দেহ থাকলে তা’যির হবে;
  • স্বীকার না করে চুপ থাকলে।

বিবাহিত

রজম (পাথর ছুড়ে হত্যা)

ব্যভিচারের অপবাদ (কযফ)

  • ৮০ টি বেত্রাঘাত;
  • ভবিষ্যতে সাক্ষ্য গ্রহণ না করা

উপযুক্ত শাস্তি না থাকলে (সম্পাদক)

ক্ষমা করে দিলে

চুরি

১ম বার

এক হাত

  • বস্তুর অর্থমূল্য ১০ দিরহামের বেশি থাকতে হবে;
  • দুর্ভিক্ষের সময় নয়; 
  • বস্তু মালিকানাধীন ও সুরক্ষিত হতে হবে; 
  • মালিকের দখলমুক্ত ও চোরের দখলাধীন থাকতে হবে;
  • চুরির ইচ্ছা ছিল;
  • দুইজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী (একজন শ্রোতা হলে তা’যির)
 

২য় বার

বিপরীত পা

৩য় বার

আরেক হাত /আরেক পা অথবা জরিমানা

৪র্থ বার

ডাকাতি-রাহাজানি

খুনসহ

মৃত্যুদণ্ড

 

স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করলে

শুধু সম্পদ লুট

একহাত ও বিপরীত পা কর্তন

হুমকি

যাবজ্জীবন বা নির্বাসন

এখন আমরা ধর্ষণ ও ব্যভিচারের শাস্তিতে আলোকপাত করব। ধর্ষণের ক্ষেত্রে ইসলামের আইন বা বিচার নিয়ে (বিষয়টির ব্যপ্তির কারণে) আলাদা আলোচনা হতে পারে। যাই হোক, পশ্চিমে ব্যভিচারের শাস্তির ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে প্রচুর আপত্তি দেখা যায়। একজন লোককে পাথর ছুড়ে মারা হবে— “কী বিভৎস! কী নৃশংস! ইসলাম হচ্ছে বর্বরদের ধর্ম”— এ ধরনের প্রচুর আলোচনা আছে। আমরা দেখতে পাই যে, ইসলামে ব্যভিচারের ক্ষেত্রে অবিবাহিত ব্যভিচারী হলে তার শাস্তি ১০০ বেত্রাঘাত। কীভাবে বেত্রাঘাত করা হবে তারও নিয়ম আছে। বেত্রাঘাতের আরবি হচ্ছে ‘জালদ।’ ‘জালদ’ থেকে জাল্লাদ / জল্লাদ শব্দটি এসেছে। নিয়ম হচ্ছে: জল্লাদ, তথা যিনি বেত্রাঘাত করবেন তার বগল দেখা যাবে না। অনেক জোরে যখন মারা হয়, তখন সাধারণত হাত উঁচু করতে হয়। (শাস্তি প্রদানের সময়) সে পরিমাণ হাত উঁচু করা যাবে না, যাতে করে জল্লাদের বগল দেখা যায়। হাত বেশি উঁচু না করে যত জোরে মারা সম্ভব সেভাবে মারতে হবে। ১০০ বেত্রাঘাত বলতে আমরা যেরকম বুঝি— অনেক বেশি, অনেক গুরুতর বা একদম মরেই যাবে— ব্যাপারটা কিন্তু আসলে সেরকম নয়।

যিনাকারী যদি বিবাহিত হয়, তাহলে তাকে রজম করতে হবে, অর্থাৎ পাথর ছুড়ে হত্যা করতে হবে, নারী এবং পুরুষ উভয়কেই। যদি নারীর অসম্মতি প্রমাণিত হয়, অর্থাৎ ধর্ষণ, সেক্ষেত্রে ব্যাপারটি আলাদা। অসম্মতির প্রমাণ কি হবে? অসম্মতির প্রমাণ হচ্ছে: নারী চিৎকার করবে, হাত-পা ছোড়াছুড়ি করবে, এর দ্বারা তার শরীরের অন্যান্য জায়গায় অনেক ইনজুরি হবে। এছাড়াও ধর্ষক যদি অস্ত্র দেখায়, অর্থাৎ তার কাছ থেকে যদি অস্ত্র উদ্ধার হয়, তাহলে এটিও জোরজবরদস্তির প্রমাণ। এসব ক্ষেত্রে নারীকে আর কোনো শাস্তি দেওয়া হবে না, এ ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সরাসরি হাদিস আছে, সেক্ষেত্রে শুধু পুরুষের শাস্তি হবে। শাস্তি দিতে হলে অবশ্যই ব্যভিচার প্রমাণিত হতে হবে। একটা বিষয় আদালতে প্রমাণ না হলে তো শাস্তি দেওয়া যায় না, এবং প্রমাণ যদি নির্দিষ্ট পর্যায়ে পৌঁছে, তাহলেই সেটাকে হদ্দ হিসেবে গণ্য করা হবে। আর যদি নির্দিষ্ট পর্যায়ের প্রমাণ না থাকে, কিন্তু অল্পবিস্তর প্রমাণ থাকে— যাতে বোঝা যায় যে ঘটনাটি ঘটেছে বা সেই ব্যক্তি অপরাধী, তাহলে তা’যিরের আওতায় শাস্তি হবে। সেটা তখন বেত্রাঘাতের দিকে চলে যাবে বা কারাদণ্ডের দিকে চলে যাবে বা অন্য দিকে চলে যাবে, হত্যার দিকে থাকবে না। তবে, এমন নয় যে, শাস্তিই হবে না।

হদ্দ পর্যায়ে যদি শাস্তি দিতে হয় তাহলে কি কি করতে হবে? প্রথম বিষয় হলো স্বীকারোক্তি। এক্ষেত্রে প্রথমে স্বীকারোক্তি নিতে বাধা দেওয়া হবে। কয়েকবার বাধা দেওয়া হবে, (বলা হবে) ‘তুমি স্বীকার করো না।’ এরপরও যদি সে স্বীকার করে, তাহলে চারটি আলাদা আলাদা মজলিসে স্বীকার করতে হবে। শর্তগুলো কিন্তু বেশ কঠিন! একজন মানুষকে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হবে— শুনতে খুব ভয়ঙ্কর শোনা যাচ্ছে, কিন্তু এটা প্রমাণ হওয়াটাও সেই পরিমাণ কঠিন। কিন্তু যদি এমন হয় যে, পাথর ছুড়ে মারার আগে তথা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে সে স্বীকারক্তি প্রত্যাহার করছে? এক্ষেত্রে যদিও সে আগে স্বীকারোক্তি দিয়েছে, তারপরও তাকে ছেড়ে দিতে হবে। যদি পাথর ছোড়ার মুহূর্তে সে পালিয়ে যায়, তবে তাকে পালাতে দিতে হবে। ব্যাপারটা শুনতে যে পরিমাণ ভয়াবহ, কার্যকর হওয়াটাও ততটাই কঠিন। যদি সে স্বীকারোক্তি না দেয়, কিন্তু চারজন সাক্ষী থাকে? যদি সেই নারী এবং সেই পুরুষকে সুরমা-দানি অবস্থায় তথা যোনির ভিতরে লিঙ্গ প্রবেশরত অবস্থায় চারজন লোক দেখে ফেলে? একজন মানুষ যখন ব্যভিচার করে তখন কি সে চারজন লোক সাক্ষী রেখে করে? অর্থাৎ চারজন সাক্ষী দেখছে— এটা আসলে প্রমাণ করা খুবই কঠিন। একমাত্র যদি কেউ ব্যাপক পরিমাণে প্রকাশ্য যিনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তখনই এটা সম্ভব।

পশ্চিমা দুনিয়ায় কিন্তু এসব হয়। যেমন: পার্কে পার্কে, সমুদ্রসৈকতে তারা জনসম্মুখে ব্যভিচার করছে। যদি এমনটি হয়, তাহলে আপনি চারজন সাক্ষী পাবেন, যারা এটি দেখেছে। প্রকাশ্যে যদি যিনা হয়, তাহলে পাথর ছুড়ে হত্যা করা তো একটি যৌক্তিক শাস্তি। প্রকাশ্যে যারা কুকুরের মত যিনায় লিপ্ত হচ্ছে— এমনভাবে যে চারজন সাক্ষী পাওয়া গেছে-  তাহলে তাকে পাথর ছুড়ে হত্যা না করলে এই সমাজ টিকবে কীভাবে? মানুষের মধ্যে আপনি নৈতিকতা কীভাবে বজায় রাখবেন? একটি পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস, আদর্শ পরিবার, সন্তানদের সুস্থ মন-মানসিকতা— এগুলো আপনি কীভাবে নিশ্চিত করবেন যদি এই প্রকাশ্যে যিনাকারীদের আপনি একটি গুরুতর শাস্তি না দেন? 

সুতরাং, যদি চারজন সাক্ষী পাওয়া যায়, তাহলেই শাস্তি হবে। চারজনের যদি একজনও কম হয়, তাহলে বাকিদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে। ধরা যাক, তিনজন দেখেছে বা দুইজন দেখেছে। দুইজন দেখেও কিন্তু মামলা করতে পারবে না। তারা মামলা করার বা সাক্ষী দেওয়ার সাহসই পাবেনা। এটা কিন্তু ধর্ষণের ক্ষেত্রে না। ধর্ষণের ক্ষেত্রে চারজন সাক্ষী লাগে না। এক্ষেত্রে যদি নারী মামলা করে এবং যথেষ্ট পরিমাণে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, তার সাথে জোরপূর্বক সহবাস করা হয়েছে, তাহলে চারজন সাক্ষীর প্রয়োজন নেই।

বিবাহিত যিনাকারীকে পাথর ছুড়ে হত্যা করার শাস্তিটা কিন্তু ভয়াবহ। যে কোনো আইন এমন হতে হবে যেন শুনতে ভয় লাগে, নাহলে সমাজকে আপনি ফেরাবেন কীভাবে? ডিটারেন্স তৈরি করবেন কীভাবে?

(প্রকাশ্য ব্যভিচারের) আরও বিষয় আছে, যদি আসামি স্বীকার না করে বা চুপ থাকে, তাহলে কী হবে? পর্যাপ্ত সাক্ষী না পাওয়া গেলে একটাই উপায় আছে— যদি আসামি নিজ মুখে স্বীকার করে। সেক্ষেত্রে আসামির এই অধিকার আছে যে, সে স্বীকার না করে চুপ থাকবে। সেক্ষেত্রেও হদ্দের অধীনে এটার বিচার হবে না, তা’যিরে চলে যাবে। মানে হত্যা করা হবে না, কিন্তু অন্য শাস্তি হবে।

(হদ্দের আওতায় আলোচিত) দুই নম্বর অপরাধ হলো ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়া। কোনো নারী বা পুরুষকে ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়া কিন্তু গুরুতর ব্যাপার, এটাকে বলা হয় ‘কযফ।’ এর শাস্তি হচ্ছে তাকে ৮০ টি বেত্রাঘাত করা হবে (হানাফি মাযহাব), শাফিয়ি মাযহাব অনুসারে ৪০ টি বেত্রাঘাত, এবং যতদিন সে বেঁচে থাকবে, ততদিন সাক্ষী হিসেবে অযোগ্য বিবেচিত হবে, মিথ্যুক হিসেবে প্রমাণিত হবে, তার কোনো সাক্ষী ভবিষ্যতে গ্রহণ করা হবেনা, কিন্তু যার নামে অপবাদ দেওয়া হয়েছে সে যদি ক্ষমা করে দেয়, তাহলে এই শাস্তি আর হবে না।

তিন নম্বর অপরাধ, যার বিচার হদ্দের অধীনে হয়— সেটি হলো চুরি। চুরির ক্ষেত্রেও আবার বিষয় আছে। সাধারণভাবে চুরির শাস্তি তা-ই যা আল্লাহ তায়ালা কুরআনের মধ্যে সরাসরি উল্লেখ করেছেন: “পুরুষ চোর এবং মহিলা চোর, তাদের উভয়ের হাত কেটে দাও।” ( সুরা মায়িদা : ৩৮) চুরির ক্ষেত্রে নিয়ম হলো: প্রথমবার তার এক হাত কাটা হবে। যদি সে আবার চুরি করে, তখন তার যেই হাত কাটা হয়েছিল, তার বিপরীত পা কাটা হবে। হাত কাটা হবে কবজি থেকে, কনুই থেকে নয়, অর্থাৎ শুধু হাতের পাঞ্জাটা কেটে দেওয়া হবে, যাতে বাকি হাত দিয়ে সে কোনো না কোনো কাজ-টাজ করতে পারে। তৃতীয়বার যদি কেউ চুরি করে, তাহলে কোনো কোনো মাযহাব বলছে, তার অবশিষ্ট হাত কাটা হবে; চতুর্থবার চুরি করলে আরেক পা কাটা হবে। আর হানাফী মাযহাব অনুসারে তৃতীয় ও চতুর্থবারসহ এরপরের প্রতিবারই তার জরিমানা করা হবে; অন্য কিছু কাটা হবে না। অর্থাৎ এক হাত ও এক পা কাটা- এটুকু পর্যন্ত সকল মাযহাব একমত; এরপরে আবার কিছুটা পার্থক্য হয়েছে। এটি পশ্চিমা সমালোচকদের আরেকটি সমালোচনার জায়গা— হাত কেটে দিবে! কি ভয়াবহ শাস্তি!

এখানেও যতটা ভয়াবহ শোনা যাচ্ছে, বাস্তবে ততটা ভয়াবহ নয়। হদ্দ প্রমাণ করা খুব কঠিন; কিছু শর্ত থাকতে হবে। যদি সেই প্রমাণগুলো না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে তা’যিরের অধীনে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে, অর্থাৎ হাত কাটা হবে না; হয়তোবা বেত দিয়ে পেটানো হবে বা কারাদণ্ড দেওয়া হবে, কিন্তু কিছু শর্ত পূরণ হতে হবে:

  • সে যে সম্পদটা চুরি করেছে, তার দাম হতে হবে ১০ দিরহামের চেয়ে বেশি;
  • অবশ্যই সম্পদটির অর্থমূল্য থাকতে হবে। যার কোনো অর্থমূল্য নেই— এমন কোন জিনিস চুরি হলে এই শাস্তি হবে না;
  • দুর্ভিক্ষের সময় যদি চুরি হয়, তাহলে তা হদ্দের অধীনে বিচার হবে না; তা’যিরের অধীনে চলে যাবে। কারণ, মানুষ ক্ষুধার কষ্টে চুরি করতে পারে, এ ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস আছে;
  • চুরি করা বস্তুটি কারো মালিকানাধীন হতে হবে। পাবলিক প্রপার্টি চুরি করলে, তাও হদ্দের অধীনে বিচার হবে না; তা’যিরের অধীনে হবে;
  • বস্তুকে সুরক্ষিত থাকতে হবে। আপনি আপনার গরু রাস্তার মধ্যে বেঁধে রেখেছেন আর চোর চুরি করে নিয়ে চলে গেছে— এটা সুরক্ষিত ছিল না। আপনি গোয়ালে গরু রেখেছেন, চোর গোয়াল থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে, তাহলে এটি হদ্দের অধীনে বিচার হতে পারে;
  • পরিপূর্ণভাবে মালিকের দখলমুক্ত হতে হবে এবং চোরের দখলে থাকতে হবে। যেমন: আপনার অধীনস্থ কোন কর্মী আপনার গরু চুরি করে আপনারই কোনো গোডাউনে রেখে দিয়েছে, মানে আপনার মালিকানাধীন জায়গায়তেই আছে— সেক্ষেত্রে আবার হদ্দ আসবে না, তা’যিরের অধীনে চলে যাবে;
  • চুরির ইচ্ছা থাকতে হবে, অর্থাৎ যে চুরি করছে, সে কাজটা চুরির নিয়তেই করেছে, একদম গোপনে জিনিসটা সরিয়েছে;
  • দু’জন প্রত্যক্ষ সাক্ষী থাকতে হবে যারা এই চুরি করা দেখেছে, যেমন: চোরকে গরু নিয়ে যেতে দেখেছে। ধরা যাক, একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী আছে, আরেকজন আছে শ্রোতা— তাহলে কিন্তু হদ্দ হবে না।

তাহলে দেখুন, এই শর্তগুলো কত কঠিন! এই শর্তের অধীনে গিয়ে কারো হাত কাটা— এটা হয়তো বছরে একটা হতে পারে। এই শর্তের অধীনে কোনো বিবাহিত ব্যভিচারীকে পাথর মারা— এটা হয়তো পাঁচ বছরে একটা হবে। যত ব্যভিচার, অধিকাংশই তা’যিরের অধীনে চলে যাবে, হদ্দের অধীনে খুব কম আসবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর হককে এভাবে ছেড়ে দিয়েছেন। যে অপরাধগুলো আল্লাহর হক, আল্লাহ সেগুলো প্রমাণিত হওয়া কঠিন করছেন। বান্দার হকের ব্যাপারগুলো কিন্তু ভিন্ন; সেগুলো একদম বরাবর হতে হবে। হদ্দ কায়েম করার মতো অপরাধ, যেমন: ধর্ষণ, ব্যভিচার, চুরি— এগুলোর ক্ষেত্রে বান্দার হক (যেমন: চুরির মাল) তো তাকে ফেরত দিতেই হবে, অর্থাৎ বান্দার হক তো আদায় করতেই হবে, কিন্তু আল্লাহর হক যেটুকু আছে, যেমন: হাত কাটা, রজম– এগুলোকে আল্লাহ তায়ালা প্রমাণিত হওয়া অত্যন্ত কঠিন করেছেন, রহিত হওয়াকে সহজ করেছেন। এগুলো বরং লঘু শাস্তি, কিন্তু শুনতে মনে হবে খুব কঠিন, কারণ সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

আল্লাহু আকবার! আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ছাড়া এই বিচার ব্যবস্থা অন্য কেউ দিতে পারেন না। একমাত্র আল্লাহ, যিনি ন্যায়পরায়ণ, আল-আদল, তাঁর পক্ষেই সম্ভব এমন বিচারব্যবস্থা প্রণয়ন করা, কোনো মানুষের পক্ষে এটা সম্ভব না, সুবহানাল্লাহ!

ডাকাতি বা রাহাজানি, অর্থাৎ জোরপূর্বক জীবনের ভয় দেখিয়ে কারো সম্পদ অপহরণ করা বা লুণ্ঠন করা— এর শাস্তি কী? যদি এর মধ্যে কোনো খুন হয়ে থাকে, যেমন: ডাকাতি করতে গিয়ে একটা খুন হয়ে গেছে— সেক্ষেত্রে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। খুন হয়নি, শুধু সম্পদ লুট হয়েছে— সেক্ষেত্রে কি হবে? এক হাত ও বিপরীত দিকের পা কাটা হবে। বাংলাদেশে কত ডাকাতি! কত ছিনতাই! কেবল একটা ঘটনায় যদি এমন শাস্তি দেওয়া যেত, তাহলে কিন্তু সব নিয়ন্ত্রণে চলে আসতো। আসলে যারা চায় যে, অপরাধ না কমুক, সমাজের মধ্যে অপরাধের সুযোগ থাকুক— তারাই ইসলামী আইনের বিরোধিতা করে। এমন দৃষ্টান্তমূলক বিচার যদি একটা হতো, তাহলে সমাজের অবস্থাটা কী দাঁড়াতো চিন্তা করেছেন!

আর যদি সম্পদও লুট করেনি, খুনও হয়নি, শুধু হুমকি দিয়েছে — সেক্ষেত্রে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হবে বা দেশান্তর (নির্বাসন) করা হবে। এক্ষেত্রে শর্ত হলো: স্বীকারোক্তি থাকতে হবে। স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে হদ্দ প্রমাণ হবার পর সে চাইলে স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করতে পারবে। তখন হদ্দ প্রত্যাহার হয়ে যাবে, কিন্তু তা’যিরের অধীনে তার শাস্তি হবে।

যদি কেউ ইসলাম ত্যাগ করে, তার মৃত্যুদণ্ড হবে। হানাফী মাযহাব মতে, যদি সে নারী হয়, তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। কিন্তু অন্যান্য মাযহাব অনুসারে, নারী হলে তারও মৃত্যুদণ্ড হবে। সেক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে: তিনদিন তাকে সময় দেওয়া হবে। এই তিনদিনের মধ্যে তার সাথে উলামায়ে কেরাম দেখা করবেন, বিশেষজ্ঞরা দেখা করবেন; সংশয় নিরসন করে তাকে তওবা করতে বলা হবে। যদি সে মৌখিকভাবেও তওবা করে, অর্থাৎ অন্তর থেকে তওবা করেনি, মুখে মুখে করেছে বাঁচার জন্য, তারপরেও তার হদ্দ মওকুফ হয়ে যাবে; চাইলে তা’যিরের অধীনে বিচার হতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে আর হত্যা করা হবে না, অন্যান্য শাস্তি দেওয়া হবে।

বৈধ শরয়ী শাসকের বিরুদ্ধে যদি কেউ বিদ্রোহ করে, সেক্ষেত্রে তার বিভিন্ন দণ্ড আছে। এটি আবার মাযহাব মাযহাবে ভিন্নতা আছে, এজন্য আমি এখানে আলোচনা করছিনা।

যদি কেউ মদ খায়? ধরুন, আপনি কারো মুখ থেকে মদের গন্ধ পাচ্ছেন, তবুও এটা মদ খাওয়ার প্রমাণ নয়। এমন হতে পারে সে খায়নি, হয়ত কুলি করেছে। কাজেই, এটাও প্রমাণ হিসেবে ধর্তব্য না। যদি দুইজন সাক্ষী থাকে যারা তাকে মদ খেতে দেখেছে, একদম চোখের সামনে— সেক্ষেত্রে তার মদ খাওয়াটা প্রমাণিত এবং তাকে বেত্রাঘাত করা হবে। যে লোক দরজা আটকে গোপনে খাবে, তার ক্ষেত্রে তো দুইজন চাক্ষুস সাক্ষী পাওয়া যাবে না। যদি কোনো মানুষ মদের বোতল নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটে আর প্রকাশ্যে মদ খায়— এমন হবার মানে প্রকাশ্যে একটা খারাপ কাজ ছড়িয়ে পড়ছে। এটাকে তো অবশ্যই আটকাতে হবে এবং এক্ষেত্রে ৮০ টি বেত্রাঘাত একটা যৌক্তিক শাস্তি। গোপনে তুমি দরজা আটকে কী করছ সেটা ইসলামী রাষ্ট্র দেখতে যাবে না, কিন্তু প্রকাশ্যে তুমি এমনভাবে খাবে যে, দুইজন সাক্ষী তৈরি হয়ে গেছে, তাহলে হদ্দ কায়েম হবে। আর বন্ধু-বান্ধব মিলে যখন মদ খায়, তখন বন্ধুরা কি সাক্ষী দেয়? বন্ধু নিজেও তো খায়। তার মানে একমাত্র প্রকাশ্যে মদ খেলেই এই মাদক সেবনের হদ্দ প্রমাণিত হবে এবং তাকে হদ্দের শাস্তি দেওয়া হবে। যদি সাক্ষী দু’জন না পাওয়া যায়, কিন্তু মদ খাওয়া প্রমাণিত হয়েছে, সেক্ষেত্রে হদ্দ না হয়ে তা’যির শাস্তি হবে।

আশা করি আমরা বিষয়গুলো সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা পেয়েছি। এখানে ‘মানসাঙ্ক’ বই থেকে একটা বিষয় তুলে ধরা হয়েছে— ধর্ষণ আর ব্যভিচার এক না। এটা নিয়ে সবার মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে। সবাই মনে করে ধর্ষণের ক্ষেত্রে ব্যভিচারের মত চারজন সাক্ষীই লাগে, এটা একটা ভুল ধারণা। প্রকৃতপক্ষে ধর্ষণের ক্ষেত্রে চারজন সাক্ষী লাগে না, এখানে নারী নিজেই মামলা করতে পারে। অপরাধ যদি প্রমাণিত হয়, অথবা যদি পরিপূর্ণভাবে নাও হয়, তবুও তা’যির শাস্তি দেবার জন্য চারজন সাক্ষী দরকার নেই, আসামির স্বীকারোক্তিও দরকার নেই। বিচারক যদি মনে করেন যে, অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে, তাহলে তিনি হদ্দ না দিয়ে তা’যির দিতে পারেন।

যদি মহিলাকে অস্ত্রের মুখে, জীবন নাশের ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করা হয়, সেক্ষেত্রে এটা হেরাবা, অর্থাৎ ডাকাতি হয়ে যাবে। তখন ডাকাতির শাস্তিগুলো তার উপর বর্তাবে। ইবনে আবদুল বার (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “যদি হদ্দ শাস্তি প্রাপ্যতার সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকে বা ধর্ষক নিজ মুখে স্বীকার করে, তাহলে তাকে হদ্দ শাস্তি দেওয়া হবে। অন্যথায় বিচারক তাকে এমন শাস্তি দিবেন, যা তাকে এবং তার মত অন্যদেরকে অপরাধ করতে বাধা দিবে।” সেটা মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। উদাহরণ: মাগুরাতে কিছুদিন আগে আছিয়া নামের ছোট্ট একটি বাচ্চাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হলো। কত ভয়াবহ একটা ব্যাপার! এক বাবা আর তার দুই ছেলে মিলে তাকে ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণ করার আগে ছোট বাচ্চাটির যোনিপথে ধারালো জিনিস দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। ধরুন, আমরা চারজন সাক্ষী পাইনি, অপরাধীরা স্বীকারও করেনি; আবার নিহতের পক্ষ থেকে মামলাও করা হয়নি (নিহত ব্যক্তির তো নিজের পক্ষে মামলা করা সম্ভব নয়)। আছিয়ার ক্ষেত্রে এখানে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, এই ধর্ষণটা এই তিনজন মিলেই করেছে। এক্ষেত্রে হদ্দ হবেনা, তা’যির হবে। তা’যির হলেও বিচারক তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারবেন, কারণ বিচারকের হাতে মৃত্যুদণ্ডের অপশন আছে। তিনি সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য, মানুষের মধ্যে ভয় তৈরি করার জন্য এবং পরবর্তীতে যেন এরকম ঘটনা আর কখনো না ঘটে তা নিশ্চিত করার জন্য ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ড দিতে পারবেন। এটাই হচ্ছে ইসলাম। সুবহানাল্লাহ! প্রতি মুহূর্তে আপনি এটা অনুভব করতে পারবেন যে, আসলেই এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে।

এবার আমরা কিসাসের ব্যাপারে আলোচনা করব। এটি পশ্চিমা দুনিয়ায় আরেকটি আপত্তির জায়গা। তারা এখন বলছে যে, মৃত্যুদণ্ডেরই দরকার নেই। সেখানে আমরা মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছি, সাথে চোখের বদলে চোখ তুলে নিচ্ছি, কানের বদলে কান কেটে নিচ্ছি, আঙ্গুলের বদলে আঙ্গুল কেটে নিচ্ছি— এটাকে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করে। যাই হোক, প্রথমে বিষয়টি আমরা জেনে নেই।  কিসাস মূলত দুটি  জিনিস — একটি হলো হত্যা, আরেকটি আঘাত বা জখম।

হত্যার ধরন

ইচ্ছাকৃত

কিসাস

ইচ্ছাসদৃশ

দিয়াত ও কাফফারা

ভুলবশত

দিয়াত ও কাফফারা

ভুলসদৃশ

দিয়াত ও কাফফারা

কারণবশত

শুধু দিয়াত

হত্যা বিভিন্নভাবে হতে পারে। এক প্রকার হলো ইচ্ছাকৃত হত্যা। যদি কেউ ইচ্ছাকৃত হত্যা করে, তাহলে প্রাণের বদলে প্রাণ— আর কোনো অপশন নেই। তাকে মেরে ফেলতে হবে, যদি না নিহতের ওয়ারিশরা তাকে মাফ করে দেয়। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: আসামিকে যদি হত্যা করতে হয়, সেক্ষেত্রে সন্দেহাতীতভাবে হত্যাকারীর হত্যার ইচ্ছা প্রমাণিত হতে হবে। দুর্ঘটনায় মারা গেলে হবে না। বরং তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যেই আসামি যে এই কাজটা করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ থাকা যাবে না। বিন্দুমাত্র যদি সন্দেহ থাকে, তাহলে সেটা আর কিসাসের ধাপে থাকবে না, পরের ধাপে (হত্যার দ্বিতীয় প্রকার) চলে যাবে,  সেটা হচ্ছে ইচ্ছা-সদৃশ, মানে দেখে মনে হচ্ছে যে, সে ইচ্ছাকৃত করেছে, কিন্তু আসলে সে ইচ্ছাকৃত করেনি। 

ধরুন, কোনো জায়গায় দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি হচ্ছে। এখন, এক পক্ষ আরেক পক্ষকে বাঁশ দিয়ে একটা বাড়ি দিয়েছে, মাথায় লেগেছে এবং মারা গেছে। আসলে মারার ইচ্ছা ছিল না; দুর্ঘটনাবশত লেগে মারা গিয়েছে। সেক্ষেত্রে তার কিসাস হবে না। তাকে দিয়াত (রক্তপণ) এবং কাফফারা দিতে হবে। কাফফারা কী? কাফফারা হলো একটি দাস মুক্ত করতে হবে অথবা ৬০ দিন একটানা রোজা রাখতে হবে। এটা আমাদের পার্থিব হিসেবে না, এটা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য। এর পাশাপাশি কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থকে রক্তপণ পরিশোধ করতে হবে।

তৃতীয় প্রকার হচ্ছে: ভুলবশত সংঘটিত হত্যা। সেক্ষেত্রেও একই জিনিস, তথা রক্তপণ এবং কাফফারা। চতুর্থ প্রকার  হলো ভুলবশত না, কিন্তু ভুলসদৃশ। মনে হচ্ছে যে, তার কোনো ভুল হয়েছে। কেউ একটা গর্ত খুঁড়ে রেখেছে, সেই গর্তের মধ্যে কেউ পড়ে মারা গেছে। গর্তটা সে মারার উদ্দেশ্যে খনন করেনি, অন্য কোনো উদ্দেশ্যে খুঁড়েছে, কিন্তু সেখানে পড়ে কেউ মারা গিয়েছে; সেক্ষেত্রেও পূর্ণ রক্তপণ ও কাফফারা দিতে হবে। 

পঞ্চম প্রকার হচ্ছে: কারণবশত হত্যা। যেমন: একজন ডাক্তার, যার একটা কাজ করা উচিত ছিল, সে সেটা করেনি, ফলে রোগী মারা গেছে, কাজটি করলে লোকটা মারা যেতো না। যেহেতু এক্ষেত্রে তার অবহেলা প্রকাশ পেয়েছে, তাই এটা কারণবশত হত্যা। সেক্ষেত্রে শুধু দিয়াত দিতে হবে, অর্থাৎ রক্তপণ পরিশোধ করতে হবে। অতএব, হত্যার বিষয়টাকে সঠিকভাবে বিচার করার জন্য এই পাঁচটা ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলোর আরো বিস্তারিত খুঁটিনাটি আলোচনা আছে। এখানে তা আলোচনা করা হবে না।

এখন, রক্তপণ কী দেওয়া হবে? নিম্নোক্ত কয়েকটি জিনিসের যেকোনো একটি দিয়ে রক্তপণ দেওয়া যাবে। বিচারক ঠিক করবেন কোন জিনিসটি দেওয়া হবে। যেমন:

  • ১০০ টি উট
  • ১০০০ দিনার
  • ১২০০০ দিরহাম
  • ২০০ গরু
  • ২০০০ ছাগল
  • ২০০ উন্নতমানের কাপড়

দিয়াতের মধ্যে আবার কিছু বিষয় আছে। একটা হচ্ছে উচ্চ মানের দিয়াত, যেমন: ১০০ উট যেগুলো  দেওয়া হবে, সেগুলো উচ্চ মানের উট হতে হবে। আবার নিম্নমানের ১০০ উট দিলেও হবে— এমনও হতে পারে। এগুলোর মধ্যে ভাগাভাগি আছে। কোন দিয়াতটা দেওয়া হবে— সেটি বিচারক বা মুফতি ঠিক করবেন।

আবার কাউকে জখম করার ক্ষেত্রে দুটো বিষয় আছে। একটি হলো ইচ্ছাকৃত আঘাত, আরেকটি অনিচ্ছাকৃত আঘাত। যদি ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করা হয়, তাহলে বরাবর কিসাস দিতে হবে তথা চোখের বদলে চোখ, কানের বদলে কান, আঙ্গুলের বদলে আঙ্গুল ইত্যাদি। ইচ্ছাকৃত আঘাত কীভাবে বোঝা যাবে? দেখতে হবে আঘাতের তীব্রতা কেমন। যদি আঘাত হাড় পর্যন্ত পৌঁছায়, তাহলে তা ইচ্ছাকৃত আঘাত এবং আঘাতকারী থেকে বরাবর কিসাস নেয়া হবে, তাকেও হাড় পর্যন্তই আঘাত করা হবে,  সব মাযহাবে এই বিষয়ে একমত। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে আদেশ করেছেন বরাবর বিচার করতে, তাই প্রদত্ত আঘাতের চেয়ে বেশি আঘাত দেওয়া যাবে না, বেশি দিলে জুলুম হবে। আর যদি বোঝা যায় যে, আঘাতটা অনিচ্ছাকৃত, সেক্ষেত্রে আবার কিসাস নেওয়া হবে না, শুধু রক্তপণ দিলেই চলবে।

আঘাতের ধরন

ইচ্ছাকৃত

বরাবর কিসাস (হাড় অব্দি পৌঁছালে)

অনিচ্ছাকৃত

দিয়াত

আমরা রক্তপণের বিষয়টি আলোচনা করলাম। রক্তপণ কখনো সম্পূর্ণ দিতে হবে, আবার আংশিকও দেওয়া লাগতে পারে। যেমন:

  • যেসব অঙ্গ একটি করে আছে সেসবের প্রতিটির জন্য পূর্ণ দিয়াত দিতে হবে। যেমন: জিহ্বা, যৌনাঙ্গ ইত্যাদি। অঙ্গহানি ছাড়াও দৃষ্টিশক্তি, যৌনশক্তি ইত্যাদি নষ্ট করে ফেললে পূর্ণ দিয়াত দিতে হবে;
  • যে সমস্ত অঙ্গ আমাদের দুটি করে আছে, সেগুলোর যদি একটি নষ্ট হয়, তাহলে অর্ধেক দিয়াত দিতে হবে। ধরুন, কারো একটি কান নষ্ট হয়েছে, তখন অর্ধেক দিয়াত দিতে হবে। আর যদি দুটোই নষ্ট হয়, সেক্ষেত্রে পূর্ণ দিয়াত দিতে হবে;
  • কিছু অঙ্গ ১০ টি করে আছে, যেমন: আঙ্গুল। অনিচ্ছাকৃতভাবে কারো একটি আঙ্গুল কেটে ফেলা হলে দশ ভাগের এক ভাগ দিয়াত দিতে হবে;
  • যেসমস্ত অঙ্গ অনেক আছে, যেমন: আমাদের ৩২ টি করে দাঁত আছে, অনিচ্ছাকৃতভাবে কারো একটা দাত ভেঙ্গে গেলে কী দিয়াত  দিতে হবে তা বিচারক ঠিক করবেন;

জখমের ধরন

দিয়াত

যেসব অঙ্গ একটা

পূর্ণ 

যেসব অঙ্গ দুইটা (প্রতিটির জন্য)

অর্ধেক 

যেসব অঙ্গ ১০ টি (প্রতিটির জন্য)

এক দশমাংশ

যেসব অঙ্গ অনেক (প্রতিটির জন্য)

হুকুমাতে আদল

এখন আমরা ইসলামের আইন-দর্শন (লিগ্যাল ফিলোসফি) নিয়ে আলোচনা করব। আইন দর্শন খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। একটি আইনের পিছনে যে দর্শন বা ফিলোসফি থাকে, তার ভিত্তিতেই আইনগুলো ঠিক করা হয়। এখন আমাদের আইন-দর্শন পুরোপুরিভাবে ধর্মমুক্ত বা সেকুলার। এই আইন দর্শনে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই। কিছুদিন আগে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। একজন মুফতিকেও কি রাখা হয়েছে সেখানে? আমাদের বায়তুল মোকাররমের খতিব আব্দুল মালেক সাহেব বাংলাদেশের একজন অন্যতম বড় মুফতি। এছাড়া আরো অনেক বড় বড় মুফতি সাহেব আছেন। একজনকেও রাখা হয়নি। কারণ, এই বিচার ব্যবস্থায় আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম.) কোনো স্থান নেই। “ইসলাম হচ্ছে একটা মান্ধাতার আমলের ব্যবস্থা, একটি নৃশংস ব্যবস্থা। ইসলাম থেকে আমাদের নেওয়ার কিছু নেই”— এটাই তাদের চিন্তাধারা।

মধ্যযুগে ইউরোপের কোর্টগুলো, বিশেষ করে ইতালি এবং জার্মানির কোর্টগুলাতে কী হতো না হতো— এ বিষয় নিয়ে ‘হিস্ট্রি অব দ্য কোর্টস’ নামক বইটি লেখা। সেখানে বলা হয়েছে যে, কোর্ট দুই প্রকার:

  • একুইজিটরি (Accusatory): একুইজিটরি কোর্টে বিচারক নিষ্ক্রিয় (passive)। বিচারক নিজে কোনো কিছু করবেন না। বিচারকের সামনে প্রমাণ-সাক্ষী উপস্থাপন করা হবে। তার ভিত্তিতে সে একটা রায় দিবে।
  • ইনকুইজিটরিয়াল (Inquisitorial): এখানে বিচারক নিজে বিভিন্ন জেরা করবেন, সাক্ষীদেরকে প্রশ্ন করবেন, তদন্তে উপস্থিত থাকবেন অর্থাৎ বিচারক সক্রিয় (Active)।

‘হিস্ট্রি অব দ্য কোর্টস’ বইয়ের লেখক লিখেছেন যে, ইউরোপের আইন ও বিচার ব্যবস্থা দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে আস্তে আস্তে ইনকুইজিটরিয়াল হয় তথা বিচারক সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ শুরু করে। অথচ অষ্টম শতাব্দীতে ইমাম মাওয়ার্দী (রহিমাহুল্লাহ) ‘আদাবুল কাজি’ নামক বই লিখে গিয়েছেন। আরো যারা উলামায়ে কেরাম আছেন, যেমন: বিচারপতি কাজী আবু ইউসুফ, ইমাম আবু হানিফা, তাঁর ছাত্ররা, ইমাম জুফার কাজীর আদব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ৮০০-৯০০ সালের দিকে। তার ৩০০ বছর পরে এসে ইউরোপে বিচারক সক্রিয় হয়, তবুও তারা মনে করে, ইসলাম থেকে তাদের নেওয়ার কিছুই নেই। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের মধ্যে ইসলামের কথা বলবে এমন কাউকে রাখাই হয়নি, কারণ তারা মনে করেছে বিচারের ব্যাপারে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলার কিছু নেই, অথচ কুরআনের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা কতবার বলেছেন— “তারা কি জাহিলি যুগের বিচার কামনা করে?” (সুরা মায়িদা : ৫০) আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা দিয়ে যারা বিচার করেনা, আল্লাহ তাদেরকে পর পর তিন আয়াতে প্রথমে কাফির বলছেন, তারপর জালিম বলেছেন, এরপর বলেছেন তারা ফাসিক। (সুরা মায়িদা : ৪৫-৪৭) অথচ আজকে আমরা, মুসলমানরা কী পরিমাণ উদাসীন! আজকে আমার সামনে আল্লাহ তায়ালার বিধানকে লঙ্ঘন করা হচ্ছে! আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোনো পাত্তা দেওয়া হচ্ছে না! আরো খারাপভাবে বললে, যে জুডিশিয়াল সিস্টেম থেকে আল্লাহ এবং তার রাসুলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বের করে দেওয়া হয়েছে,  তার মধ্যে আমরা ঢুকে আছি।

যাই হোক, আমরা এখন দেখব ইসলামে আইন-দর্শন কেমন। প্রথমত, ইসলামে শাস্তির মূলনীতি এমন হবে, যেন তা সাধারণ মানুষকে অন্যায় কাজে লিপ্ত হতে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। [ইবনুল হুমাম] অর্থাৎ লুতুপুতু, হাফ-লেডিস মার্কা আইন, যা শুনলে কোনো ভয় লাগে না- এমনটা চলবে না। জেলখানায় থাকব, খাবো-দাবো, ফুর্তি করব— এমন হবে না। জেলখানার মধ্যে একটু টাকা-পয়সা খরচ করলে অনেক ভালো থাকা যায়। আমি কয়েকজন অপরাধীর সাথে কথা বলেছি; চায়ের দোকানে বসলে সবার সাথে গল্প হয়। ওরা এরকম বলে, প্রতিদিন ১০০০ টাকা খরচ করলে বাইরে থেকে খাবার এনে দিবে, সিগারেট এনে দিবে, চা খাওয়া যাবে, ডিশলাইন আছে এরকম টিভির সামনে ফোম পেতে দিবে। তাবলীগের একলোক আমাকে বলেছেন, “আমি ২৮ দিন ছিলাম, বাপের ২৮ হাজার টাকা খরচ হইছে। একটা বিকাশ নম্বর দেয়া ছিল, প্রতিদিন টাকা পাঠিয়ে দেয়া লাগত। ভিতরে ভালো থাকতাম। খাবার দাবার খাওয়া যায়, ক্যান্টিন আছে।” মজার জিনিস আরকি! এগুলো কীভাবে শাস্তি হয়? এক মাস, তিন মাস, চার মাস, পাঁচ মাস, এক বছর থাকলেও তো কোনো সমস্যা নেই! অথচ আইন এমন হওয়ার কথা ছিল যা শুনলে ভয়ে অন্তরটা কেঁপে ওঠে।

দ্বিতীয়ত, আমাদের দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: শাস্তির যে বিধান দেয়া হয়েছে, তার উদ্দেশ্য প্রতিশোধ না, বরং ব্যক্তির সংশোধন এবং জননিরাপত্তা। দুটো জিনিস; প্রথমত, আগামীতে যেন মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে কেউ  সাহস না পায়, অপরাধী যেন ভয় পায়, ভীতসন্ত্রস্ত হয়। দ্বিতীয়ত, যে লোকটা অপরাধ করেছে, তার যেন সংশোধন ঘটে। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “শাস্তির উদ্দেশ্য প্রতিশোধ নয়, বরং সংশোধন। পিতা যেমন সন্তানকে, ডাক্তার যেমন রোগীকে কষ্ট দেন, বিচারক তেমনি অপরাধীকে কষ্ট দেবেন।“

সুতরাং, জনকল্যাণ এবং জননিরাপত্তা— এটাই শাস্তির মূল উদ্দেশ্য। এজন্য যদি কঠোর হতে হয়, তাহলে কঠোর হতে হবে। মানুষের জীবন হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে, তারা অনিরাপদ বোধ করছে, বাইরে বের হতে পারছে না, একটা মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়ার সময় চিন্তা করছে যে, রাস্তায় আমার মোটরসাইকেলটা যেন ছিনতাই না হয়, বাসে ডাকাতির ভয় করছে, স্বামী স্ত্রী রাতের বেলা চলতে পারছে না– মানুষের এই ভয় দূর করার জন্য যদি কঠোর হতে হয়, তাহলে কঠোর হতে হবে; যদি সহজে কাজ হয়, তাহলে সহজেই কাজ আদায় করতে হবে। [আল মাওয়ার্দী] কত সুন্দর নিয়ম! পশ্চিমা বিশ্বে প্রত্যেকটা দেশে ক্রমান্বয়ে অপরাধ বাড়ছে। যত বেশি তাদের পরিবারগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে, তত বেশি সন্তানেরা ত্রুটিপূর্ণ মানসিকতা নিয়ে বড় হচ্ছে। ডিভোর্সড পরিবারের সন্তানদের এক্সটারনালাইজিং বিহেভিয়ার (Externalizing Behaviour) বাড়ছে, অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। কিশোর অপরাধ কেন বাড়ছে— এটা নিয়ে প্রচুর আর্টিকেল আছে। আপনারা কি শুনতে পান যে, বাংলাদেশে কোথাও স্কুলে গুলি করে ২০, ৩০, ৫০ বা ১০০ টি বাচ্চা মেরে ফেলা হয়েছে? অথচ আমেরিকাতে এটা অহরহ ঘটছে! সেখানে প্রতিবছর শুধুমাত্র স্কুল শুটিংয়ের কারণে ২৮ হাজার মানুষ মারা যায়। অন্যদিকে ইসলাম বলছে যে, জনকল্যাণে যদি কঠোর হতে হয়, কঠোর হতে হবে। শাস্তি শুনতে এমন হতে হবে, যেন ভয়ে মানুষ সেটা করার কথা কল্পনাতেও আনতে না পারে।

আরেকটি বিষয় হলো সংশোধন; কারাগারে কিন্তু মানুষ সংশোধিত হয় না। আপনি একজন অপরাধীকে ছয় মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত করবেন, সে আরো বড় অপরাধী হয়ে ফেরত আসবে। কারণ, কারাগারে সে এমন অনেক মানুষের সোহবত পেয়েছে যারা আরো বড় বড় খুনি, ডাকাত। এটা আমার কথা না, এটা আমেরিকার একজন বড় লিগ্যাল ফিলোসফার ড্যানিয়েল ন্যাগিন্সের কথা। তিনি বলছেন, “কারাদণ্ড দীর্ঘায়িত করার দ্বারা অপরাধ কমে না, বরং বাড়ে।” মোটামুটি এটাই ইসলামে শাস্তির মূলনীতি। অপরাধের মাত্রা যদি অনেক বেশি হয় যে, শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে (যেমন: শিশু আছিয়ার ঘটনা), তাহলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিতে হবে। [ইবনু আবিদিন]

গ্রন্থপঞ্জি:

১. ইসলামী আইন ও আইনবিজ্ঞান, ইফা (৩ খণ্ড)।

২. সমকালীন প্রেক্ষাপটে হদ্দ-কিসাস, আলি হাসান উসামা অনূদিত।

৩. ইসলামী বিচারব্যবস্থার ইতিহাস, ড. মুস্তফা আয-যুহাইলি, সন্দীপন প্রকাশনী।

৪. Islamic Criminal Law and Procedure, ed. Matthew Lipmann.

৫. Silvia Tellenbach, Dr. Phil., Head of the section Turkey/Iran/Arab States at the Max Planck Institute for Foreign and International Criminal Law – এর একটি লেকচার।

৬. The Islamic Criminal Law System, ed. Dr. M. Cherif Bassiouni, Professor of Law, De Paul University, Chicago.

৭. The History of Courts and Procedure in Medieval Canon Law, Edited by Wilfried Hartmann and Kenneth Pennington.





Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

The Muslim Minds is a knowledge-based islamic intellectual platform led by young, research oriented muslims under the guidance of experienced scholars. Our mission is to address modern intellectual crises through deep academic analysis and revive Islamic thought as a comprehensive worldview.

Subscribe Now

    Contact Us

    Copyright © 2025 The Muslim Minds. All Rights Reserved